১০:৫৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২০ জুলাই ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৮৪)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:১৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১১ মে ২০২৫
  • 37
নজরুল
আমাদের সংসার ছিল দিন আনিয়া দিন খাওয়া। কেহই বেশি উপার্জন করিতে পারিত না। নন-কোঅপারেশন করিয়া তখনকার দিনে আমাদের মতোই ভদ্রঘরের বহু ছেলে খবরের কাগজ বিক্রয় করিতে আরম্ভ করিয়াছে। সুতরাং কাগজ বিক্রয় করার লোকের সংখ্যা ছিল অত্যধিক। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করিয়াও আমাদের কেহ চার-পাঁচ আনার বেশি উপার্জন করিতে পারিত না। আমি চৌদ্দ পয়সার বেশি কোনো দিনই উপার্জন করতে পারি নাই।
মাঝে মাঝে শরীর খারাপ থাকিলে বেশি ঘুরিতে পারিতাম না, সুতরাং উপার্জনও হইত না। সেই দিনটার খরচ কার্তিকদাদা চালাইয়া দিতেন। পরে তাঁহার ধার শোধ করিতাম। কোনো কোনো দিন আমার সেই বোনের বাড়ি গিয়া উপস্থিত হইতাম।
একদিনের কথা মনে পড়ে। কাগজ বিক্রয় করিয়া মাত্র এক আনা সংগ্রহ করিতে পারিয়াছি। দুই পয়সা চিড়া আর দুই পয়সার চিনি কিনিয়া ভাবিলাম, কোথায় বসিয়া খাই? দুপুরবেলা আমার সেই বোনের বাড়ি গিয়া উপস্থিত হইলাম। বোন আমার শুষ্ক মুখ দেখিয়া প্রায় কাঁদিয়া ফেলিলেন। তিনি আমার হাত হইতে চিঁড়া আর চিনির ঠোঙা ফেলিয়া দিয়া আমাকে আদর করিয়া বসাইয়া ভাত বাড়িয়া দিলেন।
আমি বলিলাম, “বুবু, আপনি তো খান নাই। আপনার ভাত আমি খাব না।”
বুবু বলিলেন, “আমার আজ পেট ব্যথা করছে। আমি খাব না। তুই এসে ভালো করলি।
ভাতগুলি নষ্ট হবে না।”
আমি সরল মনে তাহাই বিশ্বাস করিয়া ভাতগুলি খাইয়া ফেলিলাম। তখন অল্প বয়সে তাঁহার এ স্নেহের ফাঁকি ধরিতে পারি নাই। এখন সেই সব কথা মনে করিয়া চোখ অশ্রুপূর্ণ হইয়া আসে। হায় রে মিথ্যা। তবু যদি তাঁর মায়ের পেটের ভাই হইতাম। সাতজন্মে যাকে কোনো দিন চোখে দেখেন নাই, কত দূর সম্পর্কের ভাই আমি, তবু কোথা হইতে তাঁহার অন্তরে আমার জন্য এত মমতা সঞ্চিত হইয়া উঠিয়াছিল। এইরূপ মমতা বুঝি বাংলাদেশের সকল মেয়েদের অন্তরেই স্বতঃপ্রবাহিত হয়। বাপের বাড়ির কোনো আত্মীয়কে এদেশের মেয়েরা অযত্ন করিয়াছে, এরূপ ঘটনা ক্বচিৎ মেলে।
কার্তিকদার আড্ডার দিনগুলি বেশ কাটিয়া যাইতেছিল। কিন্তু আমাকে খবরের কাগজ বিক্রয় করিলেই তো চলিবে না। কলিকাতায় আসিয়া লেখাপড়া করিতে হইবে। নেতাদের কথায় গোলামখানা ছাড়িয়া চলিয়া আসিয়াছি; এখানকার জাতীয় বিদ্যালয়ে আমাকে পড়াশুনা করিতে হইবে। আমহার্স্ট স্ট্রীটে একদিন জাতীয় বিদ্যালয় দেখিয়া আসিলাম। ক্লাসে গিয়াও যোগ দিলাম। ভূগোল, ইতিহাস, অঙ্ক সবই ইংরেজিতে পড়ানো হয়। মাস্টার একজনও বাংলায় কথা বলেন না। কারণ ক্লাসে হিন্দিভাষী ও উর্দুভাষী ছাত্র আছে।
বাংলায় পড়াইলে তাহারা বুঝিতে পারিবে না। কিন্তু নবম শ্রেণীর ছাত্রদের কাছে ইংরেজিতে বক্তৃতা দিলে কতটাই বা তাহারা বুঝিতে পারিবে; তাদের ইংরেজি বিদ্যার পুঁজি তো আমার চাইতে বেশি নয়। সুতরাং জাতীয় বিদ্যালয়ের মোহ আমার মন হইতে মুছিয়া গেল। নেতাদের মুখে কত গরম গরম বক্তৃতা শুনিয়াছি। ইংরেজ-আমলের বিদ্যালয়গুলি গোলামখানা; উহা ছাড়িয়া বাহিরে আইস। এখানে বসন্তের মধুর হাওয়া বহিতেছে। আমাদের জাতীয় বিদ্যালয়ে আসিয়া দেখ, বিদ্যার সূর্য তার সাত ঘোড়া হাঁকাইয়া কিরূপ বেগে চলিতেছে। কিন্তু গোলামখানা ছাড়িয়া আমি কতদিন আসিয়াছি, বসন্তের হাওয়া তো বহিতে দেখিলাম না। জাতীয় বিদ্যালয়ের সেই সাত ঘোড়ার গতিও অনুভব করিতে পারিলাম না।

চলবে…..

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৮৪)

১১:০০:১৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১১ মে ২০২৫
নজরুল
আমাদের সংসার ছিল দিন আনিয়া দিন খাওয়া। কেহই বেশি উপার্জন করিতে পারিত না। নন-কোঅপারেশন করিয়া তখনকার দিনে আমাদের মতোই ভদ্রঘরের বহু ছেলে খবরের কাগজ বিক্রয় করিতে আরম্ভ করিয়াছে। সুতরাং কাগজ বিক্রয় করার লোকের সংখ্যা ছিল অত্যধিক। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করিয়াও আমাদের কেহ চার-পাঁচ আনার বেশি উপার্জন করিতে পারিত না। আমি চৌদ্দ পয়সার বেশি কোনো দিনই উপার্জন করতে পারি নাই।
মাঝে মাঝে শরীর খারাপ থাকিলে বেশি ঘুরিতে পারিতাম না, সুতরাং উপার্জনও হইত না। সেই দিনটার খরচ কার্তিকদাদা চালাইয়া দিতেন। পরে তাঁহার ধার শোধ করিতাম। কোনো কোনো দিন আমার সেই বোনের বাড়ি গিয়া উপস্থিত হইতাম।
একদিনের কথা মনে পড়ে। কাগজ বিক্রয় করিয়া মাত্র এক আনা সংগ্রহ করিতে পারিয়াছি। দুই পয়সা চিড়া আর দুই পয়সার চিনি কিনিয়া ভাবিলাম, কোথায় বসিয়া খাই? দুপুরবেলা আমার সেই বোনের বাড়ি গিয়া উপস্থিত হইলাম। বোন আমার শুষ্ক মুখ দেখিয়া প্রায় কাঁদিয়া ফেলিলেন। তিনি আমার হাত হইতে চিঁড়া আর চিনির ঠোঙা ফেলিয়া দিয়া আমাকে আদর করিয়া বসাইয়া ভাত বাড়িয়া দিলেন।
আমি বলিলাম, “বুবু, আপনি তো খান নাই। আপনার ভাত আমি খাব না।”
বুবু বলিলেন, “আমার আজ পেট ব্যথা করছে। আমি খাব না। তুই এসে ভালো করলি।
ভাতগুলি নষ্ট হবে না।”
আমি সরল মনে তাহাই বিশ্বাস করিয়া ভাতগুলি খাইয়া ফেলিলাম। তখন অল্প বয়সে তাঁহার এ স্নেহের ফাঁকি ধরিতে পারি নাই। এখন সেই সব কথা মনে করিয়া চোখ অশ্রুপূর্ণ হইয়া আসে। হায় রে মিথ্যা। তবু যদি তাঁর মায়ের পেটের ভাই হইতাম। সাতজন্মে যাকে কোনো দিন চোখে দেখেন নাই, কত দূর সম্পর্কের ভাই আমি, তবু কোথা হইতে তাঁহার অন্তরে আমার জন্য এত মমতা সঞ্চিত হইয়া উঠিয়াছিল। এইরূপ মমতা বুঝি বাংলাদেশের সকল মেয়েদের অন্তরেই স্বতঃপ্রবাহিত হয়। বাপের বাড়ির কোনো আত্মীয়কে এদেশের মেয়েরা অযত্ন করিয়াছে, এরূপ ঘটনা ক্বচিৎ মেলে।
কার্তিকদার আড্ডার দিনগুলি বেশ কাটিয়া যাইতেছিল। কিন্তু আমাকে খবরের কাগজ বিক্রয় করিলেই তো চলিবে না। কলিকাতায় আসিয়া লেখাপড়া করিতে হইবে। নেতাদের কথায় গোলামখানা ছাড়িয়া চলিয়া আসিয়াছি; এখানকার জাতীয় বিদ্যালয়ে আমাকে পড়াশুনা করিতে হইবে। আমহার্স্ট স্ট্রীটে একদিন জাতীয় বিদ্যালয় দেখিয়া আসিলাম। ক্লাসে গিয়াও যোগ দিলাম। ভূগোল, ইতিহাস, অঙ্ক সবই ইংরেজিতে পড়ানো হয়। মাস্টার একজনও বাংলায় কথা বলেন না। কারণ ক্লাসে হিন্দিভাষী ও উর্দুভাষী ছাত্র আছে।
বাংলায় পড়াইলে তাহারা বুঝিতে পারিবে না। কিন্তু নবম শ্রেণীর ছাত্রদের কাছে ইংরেজিতে বক্তৃতা দিলে কতটাই বা তাহারা বুঝিতে পারিবে; তাদের ইংরেজি বিদ্যার পুঁজি তো আমার চাইতে বেশি নয়। সুতরাং জাতীয় বিদ্যালয়ের মোহ আমার মন হইতে মুছিয়া গেল। নেতাদের মুখে কত গরম গরম বক্তৃতা শুনিয়াছি। ইংরেজ-আমলের বিদ্যালয়গুলি গোলামখানা; উহা ছাড়িয়া বাহিরে আইস। এখানে বসন্তের মধুর হাওয়া বহিতেছে। আমাদের জাতীয় বিদ্যালয়ে আসিয়া দেখ, বিদ্যার সূর্য তার সাত ঘোড়া হাঁকাইয়া কিরূপ বেগে চলিতেছে। কিন্তু গোলামখানা ছাড়িয়া আমি কতদিন আসিয়াছি, বসন্তের হাওয়া তো বহিতে দেখিলাম না। জাতীয় বিদ্যালয়ের সেই সাত ঘোড়ার গতিও অনুভব করিতে পারিলাম না।

চলবে…..