১১:৫১ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫
সাহিত্য প্রচারে শারজাহের ভূমিকা: সংস্কৃতি ও জ্ঞানের সেতুবন্ধন ‘আমাদের কণ্ঠ কেউ বন্ধ করতে পারবে না’—মিস ইউনিভার্স মেক্সিকোর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণে বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ উত্তর জাপানে শক্তিশালী ভূমিকম্প, সুনামি সতর্কতা ও রেল চলাচলে বিঘ্ন” জিপিএ-৫ প্রাপ্ত কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দিল আবুল খায়ের গ্রুপ “ওরা করলে, আমরা প্রস্তুত”: পাকিস্তানের পারমাণবিক পরীক্ষা ইস্যুতে রাজনাথ সিংয়ের হুঁশিয়ারি বেঙ্গালুরুর জেলে আইএস জঙ্গি ও সিরিয়াল ধর্ষকের মোবাইল ব্যবহার ফাঁস, তদন্তে নেমেছে কর্ণাটক সরকার পাকিস্তানে সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের অভূতপূর্ব পদোন্নতি — এখন দেশের প্রথম ‘চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস’ বর্তমানের সব জাতীয় সংকটই সরকারের সাজানো নাটক: মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশের সঙ্গে টাকা ও ট্যারিফ বিরোধে আন্তর্জাতিক সালিশিতে আদানি পাওয়ার” ভূমি ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনতে আধুনিক প্রশিক্ষণের ওপর জোর

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৮৬)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:১৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫
  • 116
নজরুল
আবার সেই খবরের কাগজ বিক্রয় করিতে যাই। পথে পথে ‘নায়ক নায়ক’- বলিয়া চিৎকার করি। কণ্ঠস্বর মাঝে মাঝে আমার গৃহগত মনের আবেগে সিক্ত হইয়া উঠে। দলে দলে ছেলেরা বই লইয়া ইস্কুলে যায়। দেখিয়া আমার মন উতলা হইয়া উঠে। আমিও পড়িব। দেশে গিয়া ওদের মতো বই লইয়া আমিও ইস্কুলে যাইব। এত যে পয়সার অনটন, নিজের আহারের উপযোগী পয়সাই সংগ্রহ করিতে পারি না, তবুও মাঝে মাঝে এক পয়সা দিয়া একটা গোলাপ ফুল কিনিতাম। দেশে হইলে কারও গাছ হইতে বলিয়া বা না বলিয়া ছিঁড়িয়া লইলে চলিত। এখানে ফুল পয়সা দিয়া কিনিতে হয়। আমার একহাতে খবরের কাগজের বাণ্ডিল, আর এক হাতে সেই গোলাপ ফুল। সঙ্গীসাথিরা ইহা লইয়া আমাকে ঠাট্টা করিত।
আজও আবছা আবছা মনে পড়িতেছে-তের-চৌদ্দ বৎসরের সেই ছোট্ট বালকটি আমি, মোটা খদ্দরের জামা পরিয়া দুপুরের রৌদ্রে কলিকাতার গলিতে গলিতে ঘুরিয়া ‘চাই নায়ক’ ‘চাই নায়ক’ ‘চাই বিজলী’ বলিয়া চিৎকার করিয়া ফিরিতেছি। গলির দুই পাশে ঘরে ঘরে কত মায়া, কত মমতা, কত শিশু-মুখের কলকাকলি!
গল্পে কত পড়িয়াছি, এমনি একটি ছোট্ট ছেলে পথে পথে ঘুরিতেছিল; এক সহৃদয়া রমণী তাহাকে ঘরে তুলিয়া লইলেন। আমার জীবনে এমন ঘটনা কি ঘটিতে পারে না? রবীন্দ্রনাথের ‘আপদ’ অথবা ‘অতিথি’ গল্পের সহৃদয়া মা-দুটি তো এই কলিকাতা শহরেই জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। মনে মনে কত কল্পনাই করিয়াছি। কিন্তু মনের কল্পনার মতো ঘটনা আমার জীবনে কখনও ঘটিল না। আমার নিকট সুবিস্তৃত কলিকাতা শুধু ইট-পাটকেলের শুষ্কতা লইয়াই বিরাজ করিল।
একদিন খবরের কাগজ লইয়া গলি-পথ দিয়া চলিয়াছি। ত্রিতল হইতে এক ভদ্রলোক হাত ইশারা করিয়া আমাকে ডাকিলেন। উপরে গিয়া দেখি তাঁহার সমস্ত গায়ে বসন্তের গুটি উঠিয়াছে। কোনো রকমে তাঁকে কাগজখানা দিয়া পয়সা লইয়া আসিলাম। সে দিন রাত্রে শুধু সেই বসন্তরোগগ্রস্ত লোকটিকেই মনে হইতে লাগিল। আর মাঝে মাঝে ভয় হইতে লাগিল, আমাকেও বুঝি বসন্তরোগে ধরিবে।
আস্তে আস্তে চারুবাবুর সঙ্গে দেখা করার সেই নির্দিষ্ট দিনটি নিকটে আসিল। বহু কষ্টের উপার্জিত দুইটি পয়সা খরচ করিয়া একটি বাংলা সাবান কিনিয়া ধূলি-মলিন খদ্দরের জামাটি পরিষ্কার করিয়া কাচিলাম। দপ্তরিপাড়ায় কোনো দপ্তরির সঙ্গে খাতির জমাইয়া কবিতার খাতাখানিতে রঙিন মলাট পরাইলাম। তারপর সেই বহু-আকাঙ্ক্ষিত নির্দিষ্ট সময়টিতে প্রবাসী-আফিসের দরজায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। অল্পক্ষণ পরেই আমার সেই পূর্ব-পরিচিত চারুবাবুকে সামনে দিয়া চলিয়া যাইতে দেখিলাম। তিনি আমার দিকে ফিরিয়াও চাহিলেন না। আমি তাড়াতাড়ি আগাইয়া গিয়া পদধূলি গ্রহণ করিয়া তাঁহার সামনে দাঁড়াইলাম। তিনি পূর্ব দিনের মতো করিয়াই আমাকে প্রশ্ন করিলেন “তা কি মনে করে?”
আমি তাঁহাকে স্মরণ করাইয়া দিলাম, “আপনি আমাকে আজ এই সময় আসতে বলেছিলেন। আপনি যদি আমার দু-একটি কবিতা দেখে দিতেন “
তিনি নাক সিটকাইয়া বলিলেন, “দেখুন, কবিতা লিখে কোনো কাজই হয় না। আপনি গদ্য লিখুন।”
আমি আমার গদ্য-লেখা খাতাখানা সামনে ধরিয়া বলিলাম, “আমি তো গদ্যও কিছু লিখেছি।”
ভদ্রলোক দাঁত খিঁচাইয়া ধমকের সঙ্গে বলিলেন, “মশায়, আপনি কি ভেবেছেন আপনার এই আজেবাজে লেখা পড়ার সময় আমার আছে?” এই বলিয়া ভদ্রলোক আগাইয়া চলিলেন। কিছুতেই আমার বিশ্বাস হইতেছিল না, আমার ধ্যানলোকের সেই সাহিত্যিক চারুবাবু ইনিই হইতে পারেন। ভদ্রলোকের চাকর মাছের খালুই হাতে করিয়া তাঁহার পিছনে পিছনে যাইতেছিল। আমি গিয়া তাহাকে ভদ্রলোকের নাম জিজ্ঞাসা করিলাম। চাকর কি-একটা নাম যেন বলিল। তাহাতে বুঝিতে পারিলাম, তিনি চারুবাবু নহেন।

চলবে…..

জনপ্রিয় সংবাদ

সাহিত্য প্রচারে শারজাহের ভূমিকা: সংস্কৃতি ও জ্ঞানের সেতুবন্ধন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৮৬)

১১:০০:১৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫
নজরুল
আবার সেই খবরের কাগজ বিক্রয় করিতে যাই। পথে পথে ‘নায়ক নায়ক’- বলিয়া চিৎকার করি। কণ্ঠস্বর মাঝে মাঝে আমার গৃহগত মনের আবেগে সিক্ত হইয়া উঠে। দলে দলে ছেলেরা বই লইয়া ইস্কুলে যায়। দেখিয়া আমার মন উতলা হইয়া উঠে। আমিও পড়িব। দেশে গিয়া ওদের মতো বই লইয়া আমিও ইস্কুলে যাইব। এত যে পয়সার অনটন, নিজের আহারের উপযোগী পয়সাই সংগ্রহ করিতে পারি না, তবুও মাঝে মাঝে এক পয়সা দিয়া একটা গোলাপ ফুল কিনিতাম। দেশে হইলে কারও গাছ হইতে বলিয়া বা না বলিয়া ছিঁড়িয়া লইলে চলিত। এখানে ফুল পয়সা দিয়া কিনিতে হয়। আমার একহাতে খবরের কাগজের বাণ্ডিল, আর এক হাতে সেই গোলাপ ফুল। সঙ্গীসাথিরা ইহা লইয়া আমাকে ঠাট্টা করিত।
আজও আবছা আবছা মনে পড়িতেছে-তের-চৌদ্দ বৎসরের সেই ছোট্ট বালকটি আমি, মোটা খদ্দরের জামা পরিয়া দুপুরের রৌদ্রে কলিকাতার গলিতে গলিতে ঘুরিয়া ‘চাই নায়ক’ ‘চাই নায়ক’ ‘চাই বিজলী’ বলিয়া চিৎকার করিয়া ফিরিতেছি। গলির দুই পাশে ঘরে ঘরে কত মায়া, কত মমতা, কত শিশু-মুখের কলকাকলি!
গল্পে কত পড়িয়াছি, এমনি একটি ছোট্ট ছেলে পথে পথে ঘুরিতেছিল; এক সহৃদয়া রমণী তাহাকে ঘরে তুলিয়া লইলেন। আমার জীবনে এমন ঘটনা কি ঘটিতে পারে না? রবীন্দ্রনাথের ‘আপদ’ অথবা ‘অতিথি’ গল্পের সহৃদয়া মা-দুটি তো এই কলিকাতা শহরেই জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। মনে মনে কত কল্পনাই করিয়াছি। কিন্তু মনের কল্পনার মতো ঘটনা আমার জীবনে কখনও ঘটিল না। আমার নিকট সুবিস্তৃত কলিকাতা শুধু ইট-পাটকেলের শুষ্কতা লইয়াই বিরাজ করিল।
একদিন খবরের কাগজ লইয়া গলি-পথ দিয়া চলিয়াছি। ত্রিতল হইতে এক ভদ্রলোক হাত ইশারা করিয়া আমাকে ডাকিলেন। উপরে গিয়া দেখি তাঁহার সমস্ত গায়ে বসন্তের গুটি উঠিয়াছে। কোনো রকমে তাঁকে কাগজখানা দিয়া পয়সা লইয়া আসিলাম। সে দিন রাত্রে শুধু সেই বসন্তরোগগ্রস্ত লোকটিকেই মনে হইতে লাগিল। আর মাঝে মাঝে ভয় হইতে লাগিল, আমাকেও বুঝি বসন্তরোগে ধরিবে।
আস্তে আস্তে চারুবাবুর সঙ্গে দেখা করার সেই নির্দিষ্ট দিনটি নিকটে আসিল। বহু কষ্টের উপার্জিত দুইটি পয়সা খরচ করিয়া একটি বাংলা সাবান কিনিয়া ধূলি-মলিন খদ্দরের জামাটি পরিষ্কার করিয়া কাচিলাম। দপ্তরিপাড়ায় কোনো দপ্তরির সঙ্গে খাতির জমাইয়া কবিতার খাতাখানিতে রঙিন মলাট পরাইলাম। তারপর সেই বহু-আকাঙ্ক্ষিত নির্দিষ্ট সময়টিতে প্রবাসী-আফিসের দরজায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। অল্পক্ষণ পরেই আমার সেই পূর্ব-পরিচিত চারুবাবুকে সামনে দিয়া চলিয়া যাইতে দেখিলাম। তিনি আমার দিকে ফিরিয়াও চাহিলেন না। আমি তাড়াতাড়ি আগাইয়া গিয়া পদধূলি গ্রহণ করিয়া তাঁহার সামনে দাঁড়াইলাম। তিনি পূর্ব দিনের মতো করিয়াই আমাকে প্রশ্ন করিলেন “তা কি মনে করে?”
আমি তাঁহাকে স্মরণ করাইয়া দিলাম, “আপনি আমাকে আজ এই সময় আসতে বলেছিলেন। আপনি যদি আমার দু-একটি কবিতা দেখে দিতেন “
তিনি নাক সিটকাইয়া বলিলেন, “দেখুন, কবিতা লিখে কোনো কাজই হয় না। আপনি গদ্য লিখুন।”
আমি আমার গদ্য-লেখা খাতাখানা সামনে ধরিয়া বলিলাম, “আমি তো গদ্যও কিছু লিখেছি।”
ভদ্রলোক দাঁত খিঁচাইয়া ধমকের সঙ্গে বলিলেন, “মশায়, আপনি কি ভেবেছেন আপনার এই আজেবাজে লেখা পড়ার সময় আমার আছে?” এই বলিয়া ভদ্রলোক আগাইয়া চলিলেন। কিছুতেই আমার বিশ্বাস হইতেছিল না, আমার ধ্যানলোকের সেই সাহিত্যিক চারুবাবু ইনিই হইতে পারেন। ভদ্রলোকের চাকর মাছের খালুই হাতে করিয়া তাঁহার পিছনে পিছনে যাইতেছিল। আমি গিয়া তাহাকে ভদ্রলোকের নাম জিজ্ঞাসা করিলাম। চাকর কি-একটা নাম যেন বলিল। তাহাতে বুঝিতে পারিলাম, তিনি চারুবাবু নহেন।

চলবে…..