০৬:০১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫
ইরান ইউরেনিয়াম সরিয়ে নিয়েছে এমন কোনো গোয়েন্দা তথ্য নেই: মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগন্নাথ মন্দির আর প্রসাদ বিতরণ নিয়ে কেন রাজনৈতিক বিতর্ক পশ্চিমবঙ্গে? মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা ও গঙ্গা জলচুক্তি নবায়ন নিয়ে ভারতের প্রতিক্রিয়া ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন: বাংলাদেশের বড় একটি ভুল, প্রতিশোধ বনাম সংস্কার সাকিব আল হাসান: বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের এক অমর কিংবদন্তি বাংলা নাটকের সুপারস্টার অপূর্বের জন্মদিন আজ শিবসা নদী: শতবর্ষী এক প্রাণপ্রবাহ ও তার সুন্দরবনের প্রভাব ইরান যুদ্ধ ও ‘ট্রাম্প নীতি’ চীনের বহুমুখী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গিকে ঘোলাটে করে দিচ্ছে আসিয়ান এখন আর কেবল বৈশ্বিক পুঁজির নীরব গ্রাহক নয় প্রতিদিন একটি রুমাল (পর্ব-১৯)

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৮৮)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:২২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫
  • 51
নজরুল
সাধারণ কৌতূহলের বশেই মোজাম্মেল হক সাহেবের সঙ্গে দেখা করিতে গেলাম। তিনি তখন কারমাইকেল হোস্টেলে থাকিতেন। মোজাম্মেল হক সাহেব আমার কয়েকটি কবিতা পড়িয়া খুবই প্রশংসা করিলেন এবং আশ্বাস দিয়া বলিলেন, “বৎসরের প্রথম মাসে আমার পত্রিকায় কোনো নূতন লেখকের লেখা ছাপি না। কিন্তু আপনার লেখা আমি বৎসরের প্রথম সংখ্যাতেই ছাপাব।”
আমি মুসলমান হইয়া কেন মাথায় টুপি পরি নাই-এই বলিয়া তিনি আমাকে অনুযোগ করিলেন। আমি লজ্জায় মরিয়া গেলাম। আমি বাড়ি হইতে টুপি লইয়া আসি নাই, আর এখানে টুপি কেনার পয়সা আমার নাই, সেকথা তাঁহাকে বলিতে পারিলাম না। সে আজ তিরিশ বৎসরেরও আগের কথা। তখনকার দিনে মুসলমানেরা অধিকাংশই ধুতি আর মাথায় টুপি পরিতেন। বড়রা দাড়ি রাখিতেন। আজ নতুন ইসলামি জোশ লইয়া মুসলমান-সমাজ হইতে টুপি ও দাড়ি প্রায় অন্তর্হিত হইয়াছে।
তিনি তখন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক।
মোজাম্মেল হক সাহেব আমাকে আরও বলিয়া দিলেন, “আপনি অবশ্য অবশ্য হাবিলদার কবি কাজী নজরুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে দেখা করবেন। তিনি আপনার লেখার আদর করবেন। আপনার লেখার সঙ্গে তাঁর লেখার কিছু সাদৃশ্য আছে।”
কবি নজরুল ইসলামের বেশি লেখা আমি ইহার আগে পড়ি নাই। মুসলমান লেখকের মধ্যে মহাকবি কায়কোবাদের পর আমি কবি শাহাদত হোসেন সাহেবকেই সবচেয়ে বড় লেখক বলিয়া মনে করিতাম। নজরুলের ‘বাদল বরিষণে’ নামক একটি প্রবন্ধ পড়িয়াছিলাম, তাহা রবীন্দ্রনাথের ব্যর্থ অনুকরণ বলিয়া মনে হইয়াছিল।
কবি মোজাম্মেল হক সাহেবের নিকট উৎসাহ পাইয়া পূর্ব অবহেলার ক্ষতগুলির আঘাত আমার মন হইতে কতকটা প্রশমিত হইল। আমি নজরুলের সঙ্গে দেখা করিব স্থির করিলাম। পকেটে যে যক্ষের সম্পত্তি জমা ছিল, তাহা ভালোমতো গনিয়া মনে মনে অঙ্ক কষিয়া দেখিলাম, ইহা হইতে যদি তিনটি পয়সা খরচ করি, তাহা হইলে আমার বাড়ি যাওয়ার ভাড়া কম পড়িবে না। সুতরাং তিনটি পয়সা খরচ করিয়া বৈঠকখানা রোডের এক দরজির দোকান হইতে একটি সাদা টুপি কিনিয়া মাথায় পরিয়া নজরুল সন্দর্শনে রওয়ানা হইলাম। টুপির জন্য ইতিপূর্বে মোজাম্মেল হক সাহেবের কাছে অনুযোগ শুনিয়াছি, নজরুলও হয়তো সেইরূপ অনুযোগ করিতে পারেন। সেইজন্য সেই বহু আয়াসের উপার্জিত তিনটি পয়সা খরচ করিতে হইল।
তখন নজরুল থাকিতেন কলেজ স্ট্রীটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য-সমিতির আফিসে। গিয়া দেখি, কবি বারান্দায় বসিয়া কি লিখিতেছেন। আমার খবর পাইয়া তিনি লেখা ছাড়িয়া ছটিয়া আসিলেন। আমি তাঁহাকে নিষেধ করিয়া বলিলাম, “আপনি লিখছিলেন-আগে আপনার লেখা শেষ করুন, পরে আপনার সঙ্গে আলাপ করব। আমি অপেক্ষা করছি।” কবি তাঁহার পূর্ব-লেখায় মনোনিবেশ করিলেন। আমি লেখন-রত কবিকে লক্ষ করিতে লাগিলাম। কবির সমস্ত অবয়বে কি যেন এক মধুর মোহ মিশিয়া আছে। দুটি বড় বড় চোখ শিশুর মতো সরল। ঘরের সমস্ত পরিবেশ নিরীক্ষণ করিয়া আমার ইহাই মনে হইল, এত কষ্টের তিনটি পয়সা খরচ করিয়া কিস্তি-টুপিটি না কিনিলেও চলিত। কবির নিজের পোশাকেও কোনো টুপি-আচকান-পায়জামার গন্ধ পাইলাম না।

চলবে…..

ইরান ইউরেনিয়াম সরিয়ে নিয়েছে এমন কোনো গোয়েন্দা তথ্য নেই: মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৮৮)

১১:০০:২২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫
নজরুল
সাধারণ কৌতূহলের বশেই মোজাম্মেল হক সাহেবের সঙ্গে দেখা করিতে গেলাম। তিনি তখন কারমাইকেল হোস্টেলে থাকিতেন। মোজাম্মেল হক সাহেব আমার কয়েকটি কবিতা পড়িয়া খুবই প্রশংসা করিলেন এবং আশ্বাস দিয়া বলিলেন, “বৎসরের প্রথম মাসে আমার পত্রিকায় কোনো নূতন লেখকের লেখা ছাপি না। কিন্তু আপনার লেখা আমি বৎসরের প্রথম সংখ্যাতেই ছাপাব।”
আমি মুসলমান হইয়া কেন মাথায় টুপি পরি নাই-এই বলিয়া তিনি আমাকে অনুযোগ করিলেন। আমি লজ্জায় মরিয়া গেলাম। আমি বাড়ি হইতে টুপি লইয়া আসি নাই, আর এখানে টুপি কেনার পয়সা আমার নাই, সেকথা তাঁহাকে বলিতে পারিলাম না। সে আজ তিরিশ বৎসরেরও আগের কথা। তখনকার দিনে মুসলমানেরা অধিকাংশই ধুতি আর মাথায় টুপি পরিতেন। বড়রা দাড়ি রাখিতেন। আজ নতুন ইসলামি জোশ লইয়া মুসলমান-সমাজ হইতে টুপি ও দাড়ি প্রায় অন্তর্হিত হইয়াছে।
তিনি তখন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক।
মোজাম্মেল হক সাহেব আমাকে আরও বলিয়া দিলেন, “আপনি অবশ্য অবশ্য হাবিলদার কবি কাজী নজরুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে দেখা করবেন। তিনি আপনার লেখার আদর করবেন। আপনার লেখার সঙ্গে তাঁর লেখার কিছু সাদৃশ্য আছে।”
কবি নজরুল ইসলামের বেশি লেখা আমি ইহার আগে পড়ি নাই। মুসলমান লেখকের মধ্যে মহাকবি কায়কোবাদের পর আমি কবি শাহাদত হোসেন সাহেবকেই সবচেয়ে বড় লেখক বলিয়া মনে করিতাম। নজরুলের ‘বাদল বরিষণে’ নামক একটি প্রবন্ধ পড়িয়াছিলাম, তাহা রবীন্দ্রনাথের ব্যর্থ অনুকরণ বলিয়া মনে হইয়াছিল।
কবি মোজাম্মেল হক সাহেবের নিকট উৎসাহ পাইয়া পূর্ব অবহেলার ক্ষতগুলির আঘাত আমার মন হইতে কতকটা প্রশমিত হইল। আমি নজরুলের সঙ্গে দেখা করিব স্থির করিলাম। পকেটে যে যক্ষের সম্পত্তি জমা ছিল, তাহা ভালোমতো গনিয়া মনে মনে অঙ্ক কষিয়া দেখিলাম, ইহা হইতে যদি তিনটি পয়সা খরচ করি, তাহা হইলে আমার বাড়ি যাওয়ার ভাড়া কম পড়িবে না। সুতরাং তিনটি পয়সা খরচ করিয়া বৈঠকখানা রোডের এক দরজির দোকান হইতে একটি সাদা টুপি কিনিয়া মাথায় পরিয়া নজরুল সন্দর্শনে রওয়ানা হইলাম। টুপির জন্য ইতিপূর্বে মোজাম্মেল হক সাহেবের কাছে অনুযোগ শুনিয়াছি, নজরুলও হয়তো সেইরূপ অনুযোগ করিতে পারেন। সেইজন্য সেই বহু আয়াসের উপার্জিত তিনটি পয়সা খরচ করিতে হইল।
তখন নজরুল থাকিতেন কলেজ স্ট্রীটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য-সমিতির আফিসে। গিয়া দেখি, কবি বারান্দায় বসিয়া কি লিখিতেছেন। আমার খবর পাইয়া তিনি লেখা ছাড়িয়া ছটিয়া আসিলেন। আমি তাঁহাকে নিষেধ করিয়া বলিলাম, “আপনি লিখছিলেন-আগে আপনার লেখা শেষ করুন, পরে আপনার সঙ্গে আলাপ করব। আমি অপেক্ষা করছি।” কবি তাঁহার পূর্ব-লেখায় মনোনিবেশ করিলেন। আমি লেখন-রত কবিকে লক্ষ করিতে লাগিলাম। কবির সমস্ত অবয়বে কি যেন এক মধুর মোহ মিশিয়া আছে। দুটি বড় বড় চোখ শিশুর মতো সরল। ঘরের সমস্ত পরিবেশ নিরীক্ষণ করিয়া আমার ইহাই মনে হইল, এত কষ্টের তিনটি পয়সা খরচ করিয়া কিস্তি-টুপিটি না কিনিলেও চলিত। কবির নিজের পোশাকেও কোনো টুপি-আচকান-পায়জামার গন্ধ পাইলাম না।

চলবে…..