দেবর্ষি দাশগুপ্ত
পাকিস্তান ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে ভারতীয় বিমান হামলার ধুলো এখনও পুরোপুরি বসে না–বসতেই সামাজিক মাধ্যমে অনিবার্যভাবে ভেসে উঠল নানা অযাচাইকৃত দাবি ও বিভ্রান্তিকর তথ্য, দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশীর চলমান সংঘর্ষকে ঘিরে অনিশ্চয়তা আরও বাড়িয়েছে।
বিপরীত দাবি ও অসমর্থিত সংখ্যায় ধোঁয়াশা
৭ মে ভোরের হামলায় বেসামরিক কাউকে হত্যা করা হয়নি বলে ভারতের দাবি, কিন্তু পাকিস্তান জানায় ২৬ জন নিহত ও ৪৬ জন আহত হয়েছে। কোনোটিই স্বাধীনভাবে যাচাই হয়নি। তবু এক্স (সাবেক টুইটার)‑এ শিশু-সহ নিহতদের ছবি ও পাকিস্তানি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে বিশৃঙ্খলার ভিডিও পোস্ট করে অনেকেই দাবি করছেন, সেগুলো ভারতীয় হামলায় হতাহতদের দৃশ্য।

‘অপারেশন সিঁদুর’ বিষয়ক ভারতীয় সেনাবাহিনীর বক্তব্য
৭ মে নয়াদিল্লিতে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে ব্রিফিংয়ে প্রশ্ন নেননি কর্মকর্তারা। সেনাবাহিনীর কর্নেল সোফিয়া কুরেশি জানান, “এখনও পর্যন্ত পাকিস্তানে বেসামরিক ক্ষতির কোনো খবর নেই।” বিমানবাহিনীর উইং কমান্ডার ভৌমিকা সিংহ যোগ করেন, “যেসব লক্ষ্য বেছে নেওয়া হয়েছে, সেখানে বেসামরিক অবকাঠামো ও প্রাণহানি এড়ানোর বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।” সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণ শিবির ‘সার্জিক্যাল দক্ষতায় নিষ্ক্রিয়’ করা হয়েছে বললেও ভারত হতাহতের সংখ্যা জানায়নি। অজ্ঞাত সূত্র উদ্ধৃত করে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে নিহতের সংখ্যা ৭০ জন পর্যন্ত বলা হয়েছে।
পাল্টা গোলায় ১৫ নিহত, বিমান ভূপতনের দাবি
ভারত‑শাসিত জম্মু‑কাশ্মীরে পাকিস্তানের পাল্টা গোলায় ৭ মে কমপক্ষে ১৫ বেসামরিক নিহতের কথা জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। পাকিস্তান পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে—এই দাবি নিয়ে ভারত কোনো মন্তব্য করেনি।
পুরোনো ছবি‑ভিডিওর মহড়া
এক শীর্ষ ভারতীয় ফ্যাক্ট‑চেক সংস্থার কর্মী জানান, ৭ মে সকালে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ ইনবক্স ভরে যায় ভারতীয় হামলার ‘সাফল্য’ দেখানো বিভ্রান্তিকর পোস্টে। “ইসরায়েলের গাজা আক্রমণ‑সহ বহু পুরোনো ফুটেজকে অপারেশন সিঁদুরের দৃশ্য বলে শেয়ার করা হচ্ছে,” তিনি বলেন। শুধু সাধারণ ব্যবহারকারী নন, প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যম ও জনপ্রিয় ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্টও এসব ভিজ্যুয়াল ছড়াচ্ছে। কয়েকটি ভারতীয় টিভি চ্যানেল গাজার বিস্ফোরণের ভিডিও ‘ভারতের হামলা’ বলে প্রচার করে। ৭ মে বিজেপিও নয়টি ভিডিওর কোলাজ শেয়ার করলেও অন্তত দুটোর সঙ্গে অপারেশন সিঁদুরের যোগ নেই। ফ্যাক্ট‑চেক সাইট ‘বুম’ খুঁজে পেয়েছে—একটি ক্লিপ ২০২৪‑এর অক্টোবরে ইরানের ইসরায়েল আক্রমণের, আরেকটি ২০২৩‑এর অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েলি হামলার।

পাল্টা প্রচারণা ও ভুয়া দাবি
এদিকে অনলাইনে ‘প্রো‑পাকিস্তান’ হ্যান্ডেলও পুরোনো অপ্রাসঙ্গিক ফুটেজ শেয়ার করে দাবি করছে, ভারতীয় জেট গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সামরিক স্থাপনা আক্রান্ত হয়েছে। ভারতের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরোর ফ্যাক্ট‑চেক ইউনিট এক্স‑এ এসব পোস্ট খণ্ডন করছে; ২০২১‑এ পাঞ্জাবে বিধ্বস্ত একটি ভারতীয় ফাইটারের ছবি ‘পাকিস্তানে গুঁড়িয়ে পড়া রাফাল’ বলে প্রচার করা হয়েছিল, সেটিও ভুয়া প্রমাণিত। পাকিস্তান বিমানবাহিনী শ্রীনগর বিমানঘাঁটি আক্রমণ করেছে—এমন দাবিও ভিত্তিহীন।
ট্রোল, ডিপফেক ও এআই‑এর আশঙ্কা
নিউজচেকার‑এর ম্যানেজিং এডিটর রুবি ধিংরা জানান, পাকিস্তানভিত্তিক বহু এক্স অ্যাকাউন্ট নিজেকে ভারতীয় বা ভারতীয় সেনা পরিচয় দিয়ে রাজনৈতিক টুইট করছে, যার উদ্দেশ্য বিভ্রান্তি ছড়ানো। ২ মে ছড়িয়ে পড়া এক ডিপফেক ভিডিওতে ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প’ ভারতের পক্ষে দাঁড়িয়ে বলেছে, “পাকিস্তান আক্রমণ করলে মুছে ফেলব” — সম্পূর্ণ ভুয়া। ধিংরা বলেন, “এআই‑নির্ভর কনটেন্ট এখনও মাথাচাড়া না দিলেও পরিস্থিতি ঘনীভূত হলে বাড়তে পারে।”

‘পাহেলগাম হামলা’ ও ঘৃণার টার্গেট
৭ মে‑র বিমান হামলার পেছনে ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পাহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ হিন্দু পর্যটক নিহত হওয়া—এটাই কারণ। সে হামলার পরও ভুয়া খবরের বন্যা বয়ে যায়। নিহত নৌবাহিনীর কর্মকর্তা বিনয় নারওয়ালের স্ত্রী হিমাংশি নারওয়াল মুসলিম ও কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ না ছড়ানোর আহ্বান জানাতেই কট্টর হিন্দুত্ববাদী ট্রোলের নিশানায় পড়েন। অনেকে তাঁকে ‘পাকপন্থী’ আখ্যা দিয়ে চরিত্রহননের ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে; জাতীয় মহিলা কমিশন পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করে এ হেনস্তা নিন্দা করেছে।
ভুল তথ্য ঠেকাতে সতর্ক থাকার আহ্বান
অপারেশন সিঁদুর ঘিরে ভুয়া খবরের স্রোতে ফ্যাক্ট‑চেক সংস্থাগুলো ব্যবহারকারীদের দায়িত্বশীল থাকতে, খবরের উৎস বৈচিত্র্য বাড়াতে ও প্রয়োজনে নির্ভরযোগ্য যাচাইকরণ সাইটে যোগাযোগ করতে বলেছে। বুম‑এর নিউজ এডিটর নিবেদিতা নিরঞ্জনকুমার বলেন, “কয়েকজন বিশ্বস্ত ফ্যাক্ট‑চেকারের তালিকা বানিয়ে সন্দেহজনক দাবিগুলো তাদের সাইটে খুঁজে দেখুন। না পেলে সক্রিয় হেল্পলাইন রয়েছে—তাদের কাছে যাচাই করান।”
দেবর্ষি দাশগুপ্ত স্ট্রেইটস টাইমস‑এর ভারত প্রতিনিধি, তিনি ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল নিয়ে লেখালেখি করেন।
Sarakhon Report 



















