আজরি আলমি কালোকো
দক্ষিণ‑পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক বৈচিত্র্যময় ও একসময় উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশে স্থিতিশীলতা আনয়নে আসিয়ান দীর্ঘদিন ধরে একটি নিয়ামক শক্তি হিসেবে বিবেচিত। ঔপনিবেশ‑পরবর্তী দেশগুলোকে একত্রে ধরে রাখতে ও সংঘাত এড়াতে এর সংঘাতবিমুখ ও ঐকমত্যভিত্তিক ‘আসিয়ান পন্থা’ ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু এখন এই পন্থাই জরুরি চ্যালেঞ্জের মুখে দ্রুত ও সমন্বিত পদক্ষেপের বড় বাধা হয়ে উঠেছে।
এসব চ্যালেঞ্জের কেন্দ্রে রয়েছে ঐকমত্যের ওপর আসিয়ানের নির্ভরতা। সমান কণ্ঠ দেওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি এ পদ্ধতি একসময় সংঘাত এড়িয়ে সমষ্টিগত অগ্রগতি ত্বরান্বিত করেছিল। আজকের খণ্ডিত ভূরাজনীতিতে এটি প্রায়ই সময়মতো পদক্ষেপ ব্যাহত করে; বিভাজন যত বাড়ে, একসময় একীভূতকারী এ ব্যবস্থা ততই সীমাবদ্ধ কাঠামোতে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে।
দক্ষিণ চীন সাগর তার জ্বলন্ত উদাহরণ। ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনের দাবি করা পানিসীমায় চীনা জাহাজ এখনও অনুপ্রবেশ করছে, অথচ কূটনৈতিক ভদ্রতার গণ্ডি পেরোতে আসিয়ান হিমশিম খাচ্ছে। বেইজিংয়ের সঙ্গে বাধ্যতামূলক আচরণবিধি চূড়ান্ত করতে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে আলোচনা হলেও দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। চীনের ওপর নির্ভরশীল কম্বোডিয়া ও লাওস প্রায়ই সমষ্টিগত পদক্ষেপ ভোঁতা করে দেয়।
মিয়ানমারের রাজনৈতিক সঙ্কটও জোটটির সীমাবদ্ধতা উন্মোচন করেছে। সহিংসতা কমানো ও সংলাপ চালুর লক্ষ্যে ঘোষিত পাঁচ দফা ঐকমত্য কার্যকর হয়নি, কারণ জান্তা আসিয়ানের প্রচেষ্টাকে তোয়াক্কা করছে না। এরপর কী করা উচিত—এ নিয়ে সদস্যরা বিভক্ত। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া শক্ত অবস্থান চাইলে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম অনাক্রমণীয়তার নীতি আঁকড়ে ধরে সতর্ক থাকে। ফলে লক্ষ্য বাস্তবায়নের উপায় ছাড়াই আসিয়ান অচল অবস্থায় রয়ে গেছে।
সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তোর অধীনে ইন্দোনেশিয়ার অভ্যন্তরীণ পথচলা আঞ্চলিক উদ্বেগ বাড়িয়েছে। ২০২৫ সালের মার্চে জাকার্তা কম্পোজিট সূচক ২০১১‑এর পর সর্বোচ্চ পতন দেখে এবং রুপিয়া ১৯৯৮‑পরবর্তী সঙ্কটের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যায়—জাতীয় বিনা মূল্যের খাবার কর্মসূচি ও অপারদর্শী রাজস্বনীতির মতো ব্যয়বহুল প্রকল্প নিয়ে বিনিয়োগকারীরা শঙ্কিত হওয়ায়।
এদিকে, নতুন আইনি সংশোধনী সেনাবাহিনীর বেসামরিক কাজে সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে গণতন্ত্র পশ্চাদগমনের শঙ্কা উত্থাপন করেছে। সদ্য চালু ‘দানান্তারা’ সার্বভৌম তহবিলে স্বচ্ছতার অভাব শাসনব্যবস্থার গতিপথ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এ ধরনের অভ্যন্তরীণ চাপ আঞ্চলিক অনিশ্চয়তার মাঝে আসিয়ানের ভিতরে নির্ণায়ক নেতৃত্ব প্রদানে ইন্দোনেশিয়ার সক্ষমতাও সীমিত করতে পারে।
যখন সবচেয়ে প্রভাবশালী সদস্য নিজ গৃহকোণে মনোযোগ দেয়, বাহিরে অভিন্ন অবস্থান নেওয়া আরও কঠিন হয়। অধিকাংশ আসিয়ান সরকারই সার্বভৌমত্ব ছাড়তে অনাগ্রহী—বিশেষ করে ভূখণ্ডগত বিরোধ, মানবাধিকার বা বহিঃসম্পর্কের মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে। কিন্তু জোটটি যদি আরও নমনীয় না হয়, তবে নিজ অঞ্চলেই দর্শক হয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়বে।
২০২৪‑এর জুলাইয়ে ফিলিপাইনের কেসোন সিটিতে, আন্তর্জাতিক সালিসি ট্রাইব্যুনালের ২০১৬‑র রায়ের অষ্টম বর্ষপূর্তিতে, কর্মীদের প্রতিবাদও এই অচলাবস্থারই প্রতিফলন।
জোটের চ্যালেঞ্জ কেবল অভ্যন্তরীণ নয়। আসিয়ান এখন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ক্রমবর্ধমান কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঝখানে। উভয় পরাশক্তিই দক্ষিণ‑পূর্ব এশিয়াকে তাদের দোরগোড়ায় মনে করে—অর্থনৈতিক প্রণোদনা, নিরাপত্তা জোট ও কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়ে আসিয়ান দেশগুলোকে নিজ পক্ষে টানতে চায়।
এর স্পষ্ট প্রকাশ ২০২৫‑এর মার্চে দেখা যায়, যখন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ‑পূর্ব এশীয় পণ্যের ওপর কঠিন শুল্ক আরোপ করে: ইন্দোনেশিয়ার রপ্তানিতে গড়ে ৩২%, যেখানে বস্ত্রজাত পণ্যে শুল্ক বেড়ে ৪৭% পর্যন্ত; মালয়েশিয়ার পণ্যে ২৪% এবং মিয়ানমারের রপ্তানিতে আরও বেশি। এতে বিদেশী বাজারনির্ভরতার দাম ও বহুপাক্ষিক বাণিজ্য কৌশল না থাকার খরচ চোখে পড়ে। বিদ্যমান বিভাজন তীব্রতর হয়—ভিয়েতনাম ও সিঙ্গাপুর ‘কোয়াড’ ও ‘অকাস’-কে স্বাগত জানালেও অন্য সদস্যরা বেল্ট অ্যান্ড রোডের মাধ্যমে বেইজিংয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে বাঁধা। ফলে বড় নিরাপত্তা ইস্যুতে আসিয়ান প্রায়ই সুসংগঠিত কণ্ঠে কথা বলতে পারে না।
২০২১‑এর অকাস চুক্তি এ বিভাজন স্পষ্ট করেছিল। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা ও অস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ে উদ্বেগ জানালেও অকাস সদস্যদের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় সম্পৃক্ত থেকেছে। বাকিরা নীরব থাকে বা অস্বস্তিকর সমর্থন জানায়।
এ অবস্থায় পাশ কাটিয়ে যাওয়া এড়াতে আসিয়ানকে এর কাজের ধরন পুনর্বিবেচনা করতে হবে। জোটের দরকার আরও নমনীয় মডেল, যাতে সদিচ্ছু সদস্যরা দ্বিধাগ্রস্তদের কারণে বিলম্ব ছাড়াই জরুরি ইস্যুতে পদক্ষেপ নিতে পারে। বাণিজ্য চুক্তিতে ব্যবহৃত ‘আসিয়ান‑মাইনাস‑এক্স’ পদ্ধতি সামুদ্রিক নিরাপত্তা, সাইবার শাসন বা মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যেতে পারে। এটি ঐকমত্যের বিকল্প নয়; বরং সম্পূরক—জরুরি মুহূর্তে জোট এখনও কাজ করতে পারে তা দেখায়।
তবে ‘আসিয়ান‑মাইনাস‑এক্স’ ব্যবস্থায় সুরক্ষা জরুরি। পরিষ্কার নিয়ম ছাড়া এটি অবিশ্বাস বাড়িয়ে ফাটল গভীর করতে পারে; বাদ পড়া সদস্যরা বিচ্ছিন্ন বোধ করতে পারে। ঐক্য টিকিয়ে রাখতে ব্যবস্থা‑সমাপ্তির মেয়াদ, পূর্ণ পরামর্শ ও ক্ষতিপূরণমূলক সহায়তা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে পদক্ষেপ বিভাজন নয়, ঐক্য জোরদার করে।
অর্থনৈতিক দিক থেকে আসিয়ানের উচিত ‘আরসিইপি’‑কে সম্পূর্ণ কাজে লাগানো। চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াসহ সব আসিয়ান সদস্য অন্তর্ভুক্ত এ চুক্তি বাণিজ্যে বাধা কমিয়ে আঞ্চলিক সরবরাহ শৃঙ্খল মজবুত করতে পারে। সঠিক বাস্তবায়নে অঞ্চলটি বৈশ্বিক ধাক্কা থেকে বেশি সুরক্ষিত থাকবে এবং বাণিজ্য নিয়ম প্রণয়নে জোরালো কণ্ঠ তুলতে পারবে।
তবে আরসিইপি সার্বিক মহৌষধ নয়। আসিয়ানের সব দেশ সমানভাবে লাভবান হবে না। কম উন্নত সদস্যরা প্রতিযোগিতা বা মানদণ্ড পূরণে হিমশিম খেতে পারে। তাই পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকিতে থাকা সদস্যদের কারিগরি সহায়তা, সমন্বয় ও সমর্থন বাড়াতে জোটকে বিনিয়োগ করতে হবে, যেন অর্থনৈতিক নির্ভরতা কোনও একক অংশীদারের দিকে অতিরিক্ত না ঝুঁকে পড়ে।
তবু কেবল প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার যথেষ্ট নয়। আসিয়ানের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সাহসের ওপর নির্ভর করে। নেতাদের স্পষ্ট ভাষায় কথা বলা, পদক্ষেপ নেওয়া ও নাগরিকদের সম্পৃক্ত করা জরুরি। জনআস্থা ফেরাতে স্বচ্ছতা ও নাগরিক সমাজের বড় অংশগ্রহণ অপরিহার্য।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডিজিটাল শাসন ও জলবায়ু সহনশীলতার মতো উদীয়মান খাতে আসিয়ান নেতৃত্ব দিতে পারে—যেখানে নিয়ম তৈরি করা সম্ভব, শুধুই অনুসরণ নয়। অঞ্চলের ভিন্ন কোথাও অনুপস্থিত অনন্য সমাবেশক্ষমতা দিয়ে জোটটি সামনে থেকে আলোচনার সুর ধ্বনিত করতে পারে। এগুলো ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ নয়, বর্তমান প্রাসঙ্গিকতারই পরীক্ষা।
খণ্ডিত এই বাস্তবতায় দিকনির্দেশনার জন্য দক্ষিণ‑পূর্ব এশিয়াকে এখনো একটি কাঠামো প্রয়োজন। আসিয়ান সেই ভূমিকা পালনে সেরা অবস্থানে, শর্ত শুধু একটাই—জোটটি পরিবর্তনে প্রস্তুত থাকতে হবে। যখন অপেক্ষারও দাম দিতে হয়, তখন প্রশ্ন আর এ নয় যে আসিয়ান প্রতিক্রিয়াশীল থাকবার সামর্থ্য রাখে কি না; আসল প্রশ্ন, আসিয়ান নেতৃত্ব নেওয়ার সাহস দেখাতে পারবে কি না।
আসিয়ান ব্যর্থ হলে অঞ্চল অপেক্ষা করবে না; অন্যেরা এর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেবে।
লেখক: আজরি আলমি কালোকো আসিয়ান‑যুক্তরাজ্য বিজনেস ফোরামের কৌশলগত নীতি ও গবেষণা বিভাগের প্রধান এবং দ্য জাকার্তা পোস্টসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক প্রকাশনায় নিয়মিতভাবে মতামত প্রকাশ করেন।