১০:০৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫

কাশ্মীর থেকে পানি: ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন মোড়

  • Sarakhon Report
  • ০৮:০০:২২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৪ মে ২০২৫
  • 96

হ্যাপিমন জ্যাকব

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১০ মে ডিজিএমও (ডিরেক্টর জেনারেল অব মিলিটারি অপারেশনস) পর্যায়ে স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে উভয় পক্ষের মধ্যে দ্রুত বাড়তে থাকা সামরিক উত্তেজনার ইতি ঘটেছে। জানা গেছে, এই সমঝোতা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হয়েছে। তবে ২২ এপ্রিল পাহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা থেকে শুরু করে ১০ মে যুদ্ধবিরতি পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের প্রেক্ষাপট নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। এই সময়ে সম্পর্কের এমন রূপান্তর ঘটেছে যে, পাহেলগামের আগের অবস্থায় (যেটি ছিল সম্পর্কের ন্যূনতম মাত্রা) ফিরতে হলে দুই দেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার অনেক দরকার পড়বে, স্বাভাবিক সম্পর্ক ও সংলাপে ফেরা তো বহু দূরের বিষয়। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, পাহেলগাম হামলার পর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ধরন একটি মৌলিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে, এবং তা ভারতের পক্ষে সুফল বয়ে এনেছে।

সম্পর্কের পূর্বপ্রেক্ষাপট

হামলার দিন ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক ঠিক কোথায় ছিল, তা সংক্ষেপে মনে করে নেওয়া যাক। সব দ্বন্দ্ব না মিটলেও, কার্যকর কিছু কাঠামো তখন সক্রিয় ছিল: একটি স্থিতিশীল যুদ্ধবিরতি, সিন্ধু পানি চুক্তি (IWT)-এর প্রতি উভয় পক্ষের আনুগত্য, কার্যকর কিছু আস্থা গঠনের ব্যবস্থা (CBM), সীমিত যাত্রাবিধিসহ ওয়াঘা-অটারি সীমান্ত খোলা ছিল। উচ্চপর্যায়ের কূটনীতিক (হাইকমিশনার বাদে) দুই দেশের রাজধানীতে নিযুক্ত ছিলেন এবং ভবিষ্যতে কাশ্মীর ইস্যুতে কিছু আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল।

কিন্তু ২৩ এপ্রিল, হামলার পরদিনই ভারত ঘোষণা দেয় যে, তারা সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করছে, অটারি-ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধ করছে, প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে পদ বাতিল করছে এবং আরও কিছু প্রতিক্রিয়ামূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর ফলে পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশীর মধ্যে যুদ্ধবিরতি ভেঙে পড়ে এবং পাকিস্তান ১৯৭২ সালের শিমলা চুক্তি বাতিলের হুমকি দেয়।

যুদ্ধবিরতি ও এর সীমাবদ্ধতা

১১ মে পরিস্থিতি শান্ত হয় এবং যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। কিন্তু এই যুদ্ধবিরতির প্রকৃত অর্থ কী, এবং এটি কী করে না?

১০ মে স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি একটি কারিগরি চুক্তি যা ডিজিএমও পর্যায়ে স্বাক্ষরিত — এটি নিয়ন্ত্রণ রেখা (LoC) বরাবর গোলাগুলি, গোলাবর্ষণ, ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও দূরপাল্লার অস্ত্র ব্যবহারের মতো সামরিক পদক্ষেপ বন্ধ করার লক্ষ্যে।

কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই যুদ্ধবিরতি ২৩ এপ্রিল ভারতের নেওয়া পদক্ষেপগুলোকে বাতিল করে না এবং পাকিস্তানও তাদের পদক্ষেপ থেকে সরে আসেনি। এই যুদ্ধবিরতি নিছক একটি সামরিক চুক্তি, রাজনৈতিক নয় — কারণ ডিজিএমওরা রাজনৈতিক সমঝোতা করার ক্ষমতা রাখেন না। তা করতে হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়গুলিকে, যারা এখনো সে পথে এগোয়নি। অর্থাৎ, ২২ এপ্রিলের আগের ‘যুদ্ধ-পূর্ব’ পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনা হয়নি। এখন দুই দেশের মধ্যে একটি নতুন ‘স্থিতাবস্থা’ তৈরি হয়েছে।

সিন্ধু পানি চুক্তি এখন ভারতের কূটনৈতিক হাতিয়ার

এর মানে হলো, IWT এখনো স্থগিত অবস্থায় থাকবে এবং ভারত ইচ্ছামতো নদীর পানি ব্যবহার করতে পারবে, পাকিস্তানের সঙ্গে জলসম্পর্কিত কোনো তথ্য শেয়ার না করে — যার ফলে পাকিস্তানের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে।

বিশেষ করে, ভারতের এই পদক্ষেপের ফলে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের কাঠামোই বদলে যেতে পারে। ভারত স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, পাকিস্তান যদি সন্ত্রাসবাদে ‘বিশ্বাসযোগ্য ও চূড়ান্তভাবে’ পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ না করে, তাহলে চুক্তি পুনর্বহাল হবে না। তবে ভারত চাইলে একতরফাভাবে বা পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা করে এই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করতে পারে। কিন্তু ১০ মে স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি এ বিষয়ে কিছু বলে না।

এই কারণে, ভারতের কাছে এখন IWT হয়ে উঠেছে একটি বড় চাপ প্রয়োগের কৌশল। সহজভাবে বললে, পাকিস্তান যদি ইন্দাস নদীর পানি চায়, তাহলে তাকে ভারতের সন্ত্রাসবাদবিরোধী দাবিগুলো মেনে নিতে হবে। কাশ্মীর ইস্যু পাকিস্তানের জন্য আবেগের, কিন্তু পানি প্রশ্ন জীবনের — আক্ষরিক অর্থেই।

ফলে, পাকিস্তান ভবিষ্যতেও কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে আওয়াজ তুলতে পারে বটে, তবে তাদের বাস্তব লক্ষ্য হবে IWT পুনরায় কার্যকর করানো। সেজন্য পানির বিষয়টি ভবিষ্যতে কাশ্মীরের চেয়ে বড় আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। বরং বলা যায়, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করার মধ্য দিয়ে ভারত কাশ্মীরের পরিবর্তে পানি বিষয়টিকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে।

ইতিহাস থেকে একটি দৃষ্টান্ত

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী শিমলা চুক্তিতেও ভারত একই ধরনের কৌশল নিয়েছিল। যুদ্ধ শেষে ভারত আগের ভূখণ্ডের ‘স্থিতাবস্থা’ মানতে অস্বীকৃতি জানায় (যেমনটা করেছিল ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর), এবং কাশ্মীরের সীমান্তরেখাকে ‘যুদ্ধবিরতি লাইন’-এর পরিবর্তে ‘নিয়ন্ত্রণরেখা’ (LoC) হিসেবে পুনঃনামকরণ করে। এর মাধ্যমে ভারত তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা (যেমন জাতিসংঘ) মানতে অস্বীকার করে এবং জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতিকে অগ্রাহ্য করে — কারণ ভারতের মতে, তারা এখন অস্তিত্বহীন এক যুদ্ধবিরতি লাইন পর্যবেক্ষণ করছে।

উপসংহার

পাহেলগামের সন্ত্রাসী হামলা এবং পরবর্তী কূটনৈতিক ও সামরিক প্রতিক্রিয়ার ফলে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিকে মোড় নিয়েছে:

১. পাকিস্তান চাইলেও কাশ্মীর ইস্যুকে আলোচনায় আনতে পারবে না, কারণ ভারত এখন সেই জায়গায় IWT-কে সামনে এনেছে। পাকিস্তানের পানি দরকার, ভারতের দরকার সন্ত্রাস বন্ধ। ফলে ভবিষ্যতে আলোচনার ভিত্তি হবে — পাকিস্তান সন্ত্রাস বন্ধ করলে ভারত পানি দেবে, পূর্বের মতো ‘কাশ্মীরের বিনিময়ে সন্ত্রাস বন্ধ’ নয়।

২. ভারত এই বার্তা দিয়েছে যে, ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে শত্রুতা শুরু হয় উপ-প্রথাগত (sub-conventional) স্তরে, এবং যেকোনো ভবিষ্যৎ হামলার জবাব হবে প্রথাগত (conventional) সামরিক শক্তি দিয়ে। এখন পাকিস্তানের ওপরই দায়িত্ব, তারা যদি চায় ভারতীয় প্রতিক্রিয়া এড়াতে, তাহলে যেন কোনো ধরনের উপ-প্রথাগত হামলা না হয়।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই বার্তা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অনেক প্রাণ গেছে এবং বড়সড় সামরিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা ও তা ধরে রাখা সবসময়ই মূল্যসাপেক্ষ।

লেখক: জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি পড়ান এবং ‘ইন্ডিয়াস ওয়ার্ল্ড’ নামের আন্তর্জাতিক বিষয়ক একটি পত্রিকার সম্পাদক।

কাশ্মীর থেকে পানি: ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন মোড়

০৮:০০:২২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৪ মে ২০২৫

হ্যাপিমন জ্যাকব

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১০ মে ডিজিএমও (ডিরেক্টর জেনারেল অব মিলিটারি অপারেশনস) পর্যায়ে স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে উভয় পক্ষের মধ্যে দ্রুত বাড়তে থাকা সামরিক উত্তেজনার ইতি ঘটেছে। জানা গেছে, এই সমঝোতা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হয়েছে। তবে ২২ এপ্রিল পাহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা থেকে শুরু করে ১০ মে যুদ্ধবিরতি পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের প্রেক্ষাপট নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। এই সময়ে সম্পর্কের এমন রূপান্তর ঘটেছে যে, পাহেলগামের আগের অবস্থায় (যেটি ছিল সম্পর্কের ন্যূনতম মাত্রা) ফিরতে হলে দুই দেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার অনেক দরকার পড়বে, স্বাভাবিক সম্পর্ক ও সংলাপে ফেরা তো বহু দূরের বিষয়। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, পাহেলগাম হামলার পর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ধরন একটি মৌলিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে, এবং তা ভারতের পক্ষে সুফল বয়ে এনেছে।

সম্পর্কের পূর্বপ্রেক্ষাপট

হামলার দিন ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক ঠিক কোথায় ছিল, তা সংক্ষেপে মনে করে নেওয়া যাক। সব দ্বন্দ্ব না মিটলেও, কার্যকর কিছু কাঠামো তখন সক্রিয় ছিল: একটি স্থিতিশীল যুদ্ধবিরতি, সিন্ধু পানি চুক্তি (IWT)-এর প্রতি উভয় পক্ষের আনুগত্য, কার্যকর কিছু আস্থা গঠনের ব্যবস্থা (CBM), সীমিত যাত্রাবিধিসহ ওয়াঘা-অটারি সীমান্ত খোলা ছিল। উচ্চপর্যায়ের কূটনীতিক (হাইকমিশনার বাদে) দুই দেশের রাজধানীতে নিযুক্ত ছিলেন এবং ভবিষ্যতে কাশ্মীর ইস্যুতে কিছু আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল।

কিন্তু ২৩ এপ্রিল, হামলার পরদিনই ভারত ঘোষণা দেয় যে, তারা সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করছে, অটারি-ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধ করছে, প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে পদ বাতিল করছে এবং আরও কিছু প্রতিক্রিয়ামূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর ফলে পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশীর মধ্যে যুদ্ধবিরতি ভেঙে পড়ে এবং পাকিস্তান ১৯৭২ সালের শিমলা চুক্তি বাতিলের হুমকি দেয়।

যুদ্ধবিরতি ও এর সীমাবদ্ধতা

১১ মে পরিস্থিতি শান্ত হয় এবং যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। কিন্তু এই যুদ্ধবিরতির প্রকৃত অর্থ কী, এবং এটি কী করে না?

১০ মে স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি একটি কারিগরি চুক্তি যা ডিজিএমও পর্যায়ে স্বাক্ষরিত — এটি নিয়ন্ত্রণ রেখা (LoC) বরাবর গোলাগুলি, গোলাবর্ষণ, ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও দূরপাল্লার অস্ত্র ব্যবহারের মতো সামরিক পদক্ষেপ বন্ধ করার লক্ষ্যে।

কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই যুদ্ধবিরতি ২৩ এপ্রিল ভারতের নেওয়া পদক্ষেপগুলোকে বাতিল করে না এবং পাকিস্তানও তাদের পদক্ষেপ থেকে সরে আসেনি। এই যুদ্ধবিরতি নিছক একটি সামরিক চুক্তি, রাজনৈতিক নয় — কারণ ডিজিএমওরা রাজনৈতিক সমঝোতা করার ক্ষমতা রাখেন না। তা করতে হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়গুলিকে, যারা এখনো সে পথে এগোয়নি। অর্থাৎ, ২২ এপ্রিলের আগের ‘যুদ্ধ-পূর্ব’ পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনা হয়নি। এখন দুই দেশের মধ্যে একটি নতুন ‘স্থিতাবস্থা’ তৈরি হয়েছে।

সিন্ধু পানি চুক্তি এখন ভারতের কূটনৈতিক হাতিয়ার

এর মানে হলো, IWT এখনো স্থগিত অবস্থায় থাকবে এবং ভারত ইচ্ছামতো নদীর পানি ব্যবহার করতে পারবে, পাকিস্তানের সঙ্গে জলসম্পর্কিত কোনো তথ্য শেয়ার না করে — যার ফলে পাকিস্তানের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে।

বিশেষ করে, ভারতের এই পদক্ষেপের ফলে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের কাঠামোই বদলে যেতে পারে। ভারত স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, পাকিস্তান যদি সন্ত্রাসবাদে ‘বিশ্বাসযোগ্য ও চূড়ান্তভাবে’ পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ না করে, তাহলে চুক্তি পুনর্বহাল হবে না। তবে ভারত চাইলে একতরফাভাবে বা পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা করে এই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করতে পারে। কিন্তু ১০ মে স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি এ বিষয়ে কিছু বলে না।

এই কারণে, ভারতের কাছে এখন IWT হয়ে উঠেছে একটি বড় চাপ প্রয়োগের কৌশল। সহজভাবে বললে, পাকিস্তান যদি ইন্দাস নদীর পানি চায়, তাহলে তাকে ভারতের সন্ত্রাসবাদবিরোধী দাবিগুলো মেনে নিতে হবে। কাশ্মীর ইস্যু পাকিস্তানের জন্য আবেগের, কিন্তু পানি প্রশ্ন জীবনের — আক্ষরিক অর্থেই।

ফলে, পাকিস্তান ভবিষ্যতেও কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে আওয়াজ তুলতে পারে বটে, তবে তাদের বাস্তব লক্ষ্য হবে IWT পুনরায় কার্যকর করানো। সেজন্য পানির বিষয়টি ভবিষ্যতে কাশ্মীরের চেয়ে বড় আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। বরং বলা যায়, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করার মধ্য দিয়ে ভারত কাশ্মীরের পরিবর্তে পানি বিষয়টিকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে।

ইতিহাস থেকে একটি দৃষ্টান্ত

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী শিমলা চুক্তিতেও ভারত একই ধরনের কৌশল নিয়েছিল। যুদ্ধ শেষে ভারত আগের ভূখণ্ডের ‘স্থিতাবস্থা’ মানতে অস্বীকৃতি জানায় (যেমনটা করেছিল ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর), এবং কাশ্মীরের সীমান্তরেখাকে ‘যুদ্ধবিরতি লাইন’-এর পরিবর্তে ‘নিয়ন্ত্রণরেখা’ (LoC) হিসেবে পুনঃনামকরণ করে। এর মাধ্যমে ভারত তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা (যেমন জাতিসংঘ) মানতে অস্বীকার করে এবং জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতিকে অগ্রাহ্য করে — কারণ ভারতের মতে, তারা এখন অস্তিত্বহীন এক যুদ্ধবিরতি লাইন পর্যবেক্ষণ করছে।

উপসংহার

পাহেলগামের সন্ত্রাসী হামলা এবং পরবর্তী কূটনৈতিক ও সামরিক প্রতিক্রিয়ার ফলে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিকে মোড় নিয়েছে:

১. পাকিস্তান চাইলেও কাশ্মীর ইস্যুকে আলোচনায় আনতে পারবে না, কারণ ভারত এখন সেই জায়গায় IWT-কে সামনে এনেছে। পাকিস্তানের পানি দরকার, ভারতের দরকার সন্ত্রাস বন্ধ। ফলে ভবিষ্যতে আলোচনার ভিত্তি হবে — পাকিস্তান সন্ত্রাস বন্ধ করলে ভারত পানি দেবে, পূর্বের মতো ‘কাশ্মীরের বিনিময়ে সন্ত্রাস বন্ধ’ নয়।

২. ভারত এই বার্তা দিয়েছে যে, ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে শত্রুতা শুরু হয় উপ-প্রথাগত (sub-conventional) স্তরে, এবং যেকোনো ভবিষ্যৎ হামলার জবাব হবে প্রথাগত (conventional) সামরিক শক্তি দিয়ে। এখন পাকিস্তানের ওপরই দায়িত্ব, তারা যদি চায় ভারতীয় প্রতিক্রিয়া এড়াতে, তাহলে যেন কোনো ধরনের উপ-প্রথাগত হামলা না হয়।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই বার্তা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অনেক প্রাণ গেছে এবং বড়সড় সামরিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা ও তা ধরে রাখা সবসময়ই মূল্যসাপেক্ষ।

লেখক: জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি পড়ান এবং ‘ইন্ডিয়াস ওয়ার্ল্ড’ নামের আন্তর্জাতিক বিষয়ক একটি পত্রিকার সম্পাদক।