সারাক্ষণ রিপোর্ট
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানিয়েছেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের সামরিক অভিযান থেমে গেছে, কিন্তু তা শেষ হয়ে যায়নি। যেকোনো সন্ত্রাসী হামলার জবাব ভারত নিজের শর্তে দেবে বলে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। মার্কিন মধ্যস্থতায় সপ্তাহান্তে হওয়া যুদ্ধবিরতির পর সোমবার এটাই ছিল মোদির প্রথম প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়া।
ভারত ও পাকিস্তান উভয় পক্ষই জানায়, তাদের সীমান্তবর্তী উত্তপ্ত অঞ্চলগুলোতে রাতে কোনো গোলাগুলির ঘটনা ঘটেনি। এটি সাম্প্রতিক উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে প্রথমবার, যখন কোনো দিক থেকেই গুলি চালানো হয়নি।
কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর প্রাণঘাতী হামলার পর দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশীর মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্রতর হয়ে উঠেছিল। ভারত অভিযোগ করে, এই হত্যাকাণ্ডের জন্য পাকিস্তান-সমর্থিত জঙ্গিরা দায়ী, যদিও ইসলামাবাদ তা অস্বীকার করে।
‘সন্ত্রাস ও সংলাপ একসঙ্গে চলতে পারে না‘
জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে মোদি বলেন, “পাকিস্তানের প্রতিটি পদক্ষেপ আমরা পর্যবেক্ষণ করছি।” আন্তর্জাতিক সংলাপের আহ্বানের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, “যদি ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে কথা বলে, তবে সেই আলোচনা হবে কেবল সন্ত্রাসবাদ ও পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর নিয়ে।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন, “সন্ত্রাস ও সংলাপ একসঙ্গে চলতে পারে না। তেমনি সন্ত্রাস ও বাণিজ্যও নয়।”
মোদি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতার প্রস্তাবের কোনো উল্লেখ করেননি। শনিবার ভারত ও পাকিস্তান স্থল, আকাশ ও জলপথে সব ধরনের সামরিক তৎপরতা বন্ধে সম্মত হয়।
পাকিস্তানের বক্তব্য: শান্তির চেতনায় যুদ্ধবিরতি
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ বলেন, তার দেশ “শান্তির চেতনায়” যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে, তবে দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার লঙ্ঘন কখনোই মেনে নেওয়া হবে না। এ মন্তব্য তিনি তুরস্কের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে দেন, সরকারি বিবৃতি অনুযায়ী।
সোমবার ভারত ও পাকিস্তানের উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা হটলাইনে যোগাযোগ করেন যুদ্ধবিরতি কার্যকর হচ্ছে কি না এবং তা বাস্তবায়নে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় তা পর্যালোচনার জন্য।
সেনাবাহিনীর ভাষ্য: গুলি বিনিময় বন্ধ, সেনা হ্রাসে উদ্যোগ
ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে বলা হয়, দুই দেশের কর্মকর্তারা একটিও গুলি না চালানো এবং কোনো ধরনের আক্রমণাত্মক তৎপরতা শুরু না করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। সীমান্ত ও সামনের অবস্থানগুলোতে সেনা সংখ্যা হ্রাসে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়েও তারা আলোচনা করেন।
ভারতীয় সেনাবাহিনী আরও জানায়, “জম্মু ও কাশ্মীর এবং আন্তর্জাতিক সীমান্ত সংলগ্ন অন্যান্য এলাকাগুলোতে রাত শান্তিপূর্ণ ছিল,” এবং কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।
পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে শান্তি ফিরছে
পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর কোনো গোলাগুলির খবর নেই এবং সাম্প্রতিক সংঘর্ষে গৃহচ্যুত হওয়া নাগরিকরা ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমদ শরিফ রবিবার রাতে জানান, যুদ্ধবিরতি মেনে চলার ব্যাপারে পাকিস্তান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং প্রথমে লঙ্ঘনের পথে যাবে না।
যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পরপরই পাকিস্তান দেশের সব বিমানবন্দর পুনরায় চালু করে এবং বিমান চলাচল স্বাভাবিক করে। ভারতও সোমবার উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে সাময়িকভাবে বন্ধ থাকা ৩২টি বিমানবন্দর পুনরায় খুলে দেয়।
সাম্প্রতিক সংঘর্ষে বিপুল প্রাণহানি
গত বুধবার ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এক দশকের মধ্যে অন্যতম গুরুতর সামরিক সংঘর্ষ শুরু হয়। ভারত দাবি করে, তারা পাকিস্তানের অভ্যন্তরে জঙ্গি ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালায়—যাদের তারা কাশ্মীরে ২৬ জন হিন্দু পর্যটক হত্যার জন্য দায়ী করে। এসব হত্যাকাণ্ড পর্যটকদের পরিবারের সামনেই ঘটেছিল।
এই হামলার পর পররাষ্ট্র নীতিতে পাল্টা পদক্ষেপ নেয় উভয় দেশ। একে অপরের কূটনীতিকদের বহিষ্কার, আকাশ ও স্থলসীমান্ত বন্ধ, এমনকি গুরুত্বপূর্ণ পানি চুক্তিও স্থগিত করা হয়।
ভারতের দাবি: ১০০ জঙ্গি নিহত, পাকিস্তানের দাবি: ৫০ ভারতীয় সেনা নিহত
বুধবারের পর দুই দেশ কাশ্মীরে ভারী গোলাগুলি বিনিময় করে এবং একে অপরের ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়। উভয় পক্ষই জানায়, এসব হামলায় বহু বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন।
রবিবার ভারত প্রথমবারের মতো জানায়, পাকিস্তান ও পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে চালানো হামলায় ১০০ জনের বেশি জঙ্গি নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে শীর্ষ নেতারাও ছিলেন।
ভারতের সামরিক অভিযানের মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাজীব ঘাই জানান, ভারতের সশস্ত্র বাহিনী লস্কর-ই-তৈয়বা-র প্রশিক্ষণ ঘাঁটিসহ মোট ৯টি জঙ্গি অবকাঠামো ধ্বংস করেছে।
তিনি আরও জানান, নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর সংঘর্ষে ৩৫ থেকে ৪০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছে, আর ভারতের ৫ সেনা শহীদ হয়েছেন।
অন্যদিকে, পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার বৃহস্পতিবার দাবি করেন, নিয়ন্ত্রণ রেখায় পাকিস্তানের সেনারা ৪০ থেকে ৫০ জন ভারতীয় সেনাকে হত্যা করেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আরও দাবি করেছে, তারা ৫টি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে এবং ভারতের ২৬টি স্থানে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়েছে।
উভয় দেশের দাবির স্বাধীন যাচাই সম্ভব হয়নি
এপি জানায়, ভারত ও পাকিস্তানের করা দাবিগুলোর কোনোটি স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
ভারতের বিমান বাহিনী: পুরোপুরি প্রস্তুত
ভারতের বিমান বাহিনীর অপারেশন পরিচালক এয়ার চিফ মার্শাল একে ভরতি সোমবার সংবাদ সম্মেলনে জানান, “অল্প কিছু ক্ষতি হলেও, আমাদের সব সামরিক ঘাঁটি ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে সচল রয়েছে এবং প্রয়োজনে পুনরায় অভিযান চালানোর জন্য প্রস্তুত।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন, “ভারতের লড়াই জঙ্গিদের বিরুদ্ধে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী বা বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে নয়।”