সারাক্ষণ রিপোর্ট
ভারতের কৌশলিক পদক্ষেপ: ইন্দাস চুক্তি স্থগিত ও নতুন জলনৈতিক বাস্তবতা
ভারত-পাকিস্তান ইন্দাস পানি চুক্তি ৬৫ বছর ধরে টিকেছিল বিশ্বব্যাপী এক বিরল দ্বিপাক্ষিক জলের চুক্তি হিসেবে। কিন্তু ২০২৪ সালের এপ্রিলে কাশ্মীরের পাহেলগামে জঙ্গি হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর ভারত একতরফাভাবে এই চুক্তি স্থগিত করে। সেই থেকে দক্ষিণ এশিয়ার জলবণ্টন ও সেচব্যবস্থা নিয়ে এক নতুন সংকট তৈরি হয়েছে।
এই চুক্তির আওতায় ভারত ইন্দাস নদী ব্যবস্থার তিনটি পশ্চিমাঞ্চলীয় নদী — ইন্দাস, ঝেলম ও চেনাব — থেকে পানি প্রত্যাহারে কঠোরভাবে সীমিত ছিল। পাকিস্তান এই নদীগুলোর পানি প্রাপ্তির প্রায় একচ্ছত্র অধিকার ভোগ করছিল। কিন্তু এখন সেই বাস্তবতা বদলাতে যাচ্ছে।
ভারতের বড় পরিকল্পনা: খাল সংস্কার ও নতুন খাল নির্মাণ
চুক্তি স্থগিতের পর ভারত পুরনো খালগুলোর সংস্কার ও সম্প্রসারণ এবং নতুন খাল খননের মাধ্যমে ইন্দাস নদীর পানির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে চাইছে। কাঠুয়া, নিউ প্রতাপ ও রানবীর খাল, যেগুলো শতবর্ষ পুরনো, সেগুলোতে পলি সরানো, প্রবাহ বৃদ্ধি এবং সম্প্রসারণের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। এসব খাল জম্মু ও কাশ্মীরের বিস্তীর্ণ কৃষিজমিতে সেচ সুবিধা দেবে।
এক সরকারি কর্মকর্তা জানান, “এই খালগুলোর ধারণক্ষমতা অনেক আগেই সময়োচিত হয়ে পড়েছে। নতুন পরিকল্পনায় এই খালগুলোর মাধ্যমে জলসেচের আওতা ব্যাপক হারে বাড়ানো হবে।”
ভারত আরও জানিয়েছে, রানবীর খালের ৬০ কিমি দৈর্ঘ্য এবং নিউ প্রতাপ খালের ৩৪ কিমি দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পূর্বে যেসব খাল শুধু কাগজে পরিকল্পনা ছিল, এখন তা বাস্তবায়নের পথে। এমনকি নতুন বাঁধ প্রকল্প — কিশনগঙ্গা, রাতলে, পাকাল দুল ইত্যাদি — নিয়েও সক্রিয় হচ্ছে ভারত।
পাকিস্তানের উদ্বেগ: সেচব্যবস্থা ধসে পড়ার আশঙ্কা
পাকিস্তান ইতিমধ্যে কঠোরভাবে এই চুক্তি স্থগিতের বিরোধিতা করেছে। তারা হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে, ভারত যদি পানি সরিয়ে দেয় বা বাঁধ তৈরি করে ইন্দাস নদীর প্রবাহে বাধা দেয়, তবে তা “যুদ্ধের কারণ” হিসেবে গণ্য করা হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের নতুন জলনীতি বাস্তবায়িত হলে পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে সেচ নির্ভর কৃষি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই অঞ্চলগুলো ইন্দাস নদীর পানি দিয়ে চাষাবাদের ওপর নির্ভরশীল এবং পানি সরবরাহ ব্যাহত হলে খাদ্য উৎপাদন ও কৃষক জীবিকা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হবে।
একজন পাকিস্তানি সেচ কর্মকর্তা বলেন, “পাঞ্জাবের প্রায় ৯০ শতাংশ জমি ইন্দাস নদীর পানি থেকে আসে। ভারত যদি প্রবাহ কমিয়ে দেয়, তাহলে তা ভয়াবহ খাদ্য সংকটের দিকে ঠেলে দেবে।”
বিশ্বব্যাংকের নীরবতা: বিরোধ নিষ্পত্তিতে অনাগ্রহ
ইন্দাস পানি চুক্তি স্বাক্ষরের সময় বিশ্বব্যাংক মধ্যস্থতাকারী ছিল এবং এই চুক্তির এক প্রকার গ্যারান্টরও ছিল। কিন্তু ভারত ও পাকিস্তানের চলমান বিরোধ এবং চুক্তি স্থগিতের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক এখন পর্যন্ত কার্যত নীরব।
বিশ্বব্যাংকের একজন মুখপাত্র বলেন, “চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে কোনো মন্তব্য নেই।” এতে স্পষ্ট হচ্ছে, বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বিশ্বব্যাংক ইন্দাস নিয়ে নতুন করে কোনো সক্রিয় ভূমিকা নিতে চায় না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বব্যাংকের এই নিষ্ক্রিয়তা আন্তর্জাতিক স্তরে এই সংকটের সমাধানে জটিলতা বাড়াবে। ভারতের দাবি অনুযায়ী, চুক্তি এখন আর যুগোপযোগী নয় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পূর্ব উপনদীগুলো থেকেও পানি প্রবাহ কমে গেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার সামনে নতুন জল-সংকট
ভারতের খালপথ সংস্কার ও ইন্দাস পানি ব্যবহারে অধিক হস্তক্ষেপ পাকিস্তানের কৃষি ও জীবনজীবিকায় মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। চুক্তি বাতিল বা স্থগিত হলে শুধু দুই দেশের মধ্যে নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় এক নতুন জলবিষয়ক সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি হবে। এর ফলে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়বে, খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে এবং আন্তর্জাতিক মহলের চাপ আরও বাড়বে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই জলবণ্টন নিয়ে আলোচনা ও মধ্যস্থতা ছাড়া সমাধানের পথ নেই।