সারাক্ষণ রিপোর্ট
সীমান্তে অস্বস্তির ছায়া
এস্তোনিয়ার নরভা নদীর উপর হেরমান দুর্গ ও ইভানগোরোদ দুর্গের মাঝের সেতু—যা দেশ দুটির সীমান্ত—এখন ‘মুক্ত বিশ্বের প্রান্ত’ বলে পরিচিত। রুশ পক্ষের নতুন বিশাল স্ক্রিনে ৯ মে-র বিজয় দিবসের প্যারেড দেখানো হয়, আর নদীর গর্জন যেন অতীত দখলের স্মৃতি ফিরিয়ে আনে। নিয়মিত জিপিএস চ্যানেল জ্যাম, সীমান্ত চিহ্নিতকারী বয়া তুলে নেওয়া ও নজরদারি বেলুন—এসবই প্রতিবেশীদের উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
রাশিয়ার পুনর্গঠন পরিকল্পনা
মস্কো ঘোষণা করেছে সক্রিয় বাহিনী ১৩ লাখ থেকে বাড়িয়ে ১৫ লাখ করবে। ফিনল্যান্ড সীমান্ত ঘেঁষে কারেলিয়ায় ৪৪তম আর্মি কোর গঠন শুরু হয়েছে; কয়েকটি ব্রিগেডকে পূর্ণাঙ্গ ডিভিশনে উন্নীত করা হচ্ছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শেষ হতে বছর কয়েক লাগবে, কিন্তু সফল হলে পশ্চিম সীমান্তে সৈন্য-সরঞ্জাম ৩০-৫০ শতাংশ বেড়ে যাবে বলে লিথুয়ানিয়ার গোয়েন্দাদের ধারণা।
উদ্দেশ্য বনাম সামর্থ্য
এখনই ন্যাটো আক্রমণের কোনো সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্য নেই, তবে ভ্লাদিমির পুতিনের বক্তব্যে সাবেক রুশ সাম্রাজ্যের ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারের আভাস মিলেছে। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে তিনি অতীতে পাঁচটি যুদ্ধ শুরু করেছেন; জনপ্রিয়তা কমলেই যুদ্ধ, তারপরই কর্তৃত্ব বৃদ্ধি—এটাই তার ধারাবাহিকতা।
গণের মনোভাব ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা
চিকাগো কাউন্সিল ও লেভাদা সেন্টারের সার্ভে দেখায়, অধিকাংশ রাশিয়ান যুদ্ধ শেষ দেখতে চাইলেও দেশের ‘মহাশক্তি’ ভাবমূর্তি বেড়েছে বলে মনে করে। একসময় ৬০ শতাংশ নাগরিক উন্নত জীবনমানকে অগ্রাধিকার দিত; এখন ৫৫ শতাংশ বড় শক্তি হওয়াকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে। অথচ উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও স্থবির প্রবৃদ্ধি অর্থনীতিকে চাপে ফেলছে।
সামরিক সক্ষমতার প্রকৃত চিত্র
ইউক্রেনে টানা নয় মাসের ছোট একটি শহর দখলের চেষ্টায় প্রতিদিন সহস্রাধিক হতাহত হয়েছে। ইস্কান্দার ব্যালিস্টিক ও খ-১০১ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের উৎপাদন রেকর্ড হলেও ট্যাংকের অধিকাংশই পুরোনো সোভিয়েত ভাণ্ডার থেকে সংস্কারকৃত; এই ভাণ্ডার ২০২৬ এর মধ্যে ফুরিয়ে যেতে পারে। জনশক্তি সংকটও বাড়ছে—নিয়মিত ৩০ হাজার করে সৈনিক ভর্তিও বয়সভিত্তিক জনসংখ্যা হ্রাসে স্থায়ী সমাধান নয়। বৃহৎ আকারের সমন্বিত অভিযান চালানোর মতো দক্ষ অফিসার ও স্টাফের ঘাটতি প্রকট।
কত সময় লাগবে পূর্ণ প্রস্তুতিতে
আমেরিকা বলছে, রাশিয়াকে সেনাবহিনী গুছাতে দশক লাগবে; নরওয়ে পাঁচ থেকে দশ বছর, জার্মানি পাঁচ থেকে আট, ইউক্রেন পাঁচ থেকে সাত, আর এস্তোনিয়া তিন থেকে পাঁচ বছরের কথা বলছে—সবই যুদ্ধের গতি, অর্থনীতি ও নিষেধাজ্ঞার ওপর নির্ভরশীল।
সীমিত সংঘাতের ঝুঁকি
ডেনমার্কের গোয়েন্দা হিসাব—রাশিয়া বড় পাল্লার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে পাঁচ বছর লাগলেও, বাল্টিক অঞ্চলে আঞ্চলিক যুদ্ধের প্রস্তুতি দুই বছরে এবং একক কোনও প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে স্থানীয় লড়াই ছয় মাসেই সম্ভব। ইউক্রেন থেকে মাত্র ৫০ হাজার সৈন্য সরালেও এস্তোনিয়ার সামনে শক্তির ভারসাম্য বদলে যেতে পারে।
ন্যাটোর প্রস্তুতি ও দুর্বলতা
সুইডেন-ফিনল্যান্ডের ন্যাটো যোগদানে রাশিয়ার উত্তরে চাপ বেড়েছে। আটটি সীমান্ত রাষ্ট্রে ২৮ দেশের ‘ফরওয়ার্ড’ ব্যাটলগ্রুপ আছে; আমেরিকান সেনার সংস্থানও রয়েছে। তবে বহু ইউরোপীয় দেশ লক্ষ্যবস্তুর তথ্য সংগ্রহ, জটিল বিমান অভিযানের সমন্বয় ও রুশ আকাশ প্রতিরক্ষা ভাঙার মতো মার্কিন সক্ষমতার উপর এখনো নির্ভরশীল। তবু ট্রাম্প-যুগের অনিশ্চয়তা ইউরোপকে দ্রুত সামরিক ব্যয়ে ঝুঁকতে বাধ্য করছে।
সম্ভাব্য ‘নরম’ লক্ষ্য
পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের বদলে রাশিয়া সীমিত অভিযান বেছে নিতে পারে—উদাহরণস্বরূপ, আর্কটিকের স্পিত্সবার্গেন (স্ভালবার্ড) দ্বীপপুঞ্জ বা ন্যাটো-বহির্ভূত মলদোভায় ট্রান্সনিস্ট্রিয়া থেকে অগ্রসর হওয়া, যাতে মিত্রদের একতাবদ্ধ প্রতিক্রিয়া পেতে সময় লাগে।
উপসংহার: বড় যুদ্ধ কম সম্ভাব্য, ছোট উত্তেজনা নয়
বর্তমানে ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে থাকা ও আঘাতপ্রাপ্ত রুশ বাহিনী ন্যাটোর বিরুদ্ধে বড় আক্রমণ চালাতে পারবে না। তবে আগামী কয়েক বছরে—বিশেষত পশ্চিমা সংহতি দুর্বল হলে—রাশিয়া সীমিত সামরিক পদক্ষেপ বা প্ররোচনা বাড়াতে পারে। বিভ্রান্তিকর পূর্বাভাসের যুগে অতিরিক্ত আত্মতুষ্টি যতটা বিপজ্জনক, অতিরিক্ত আতঙ্কও ততটাই ক্ষতিকর; নীতিনির্ধারকদের দুয়ের মাঝে সঠিক ভারসাম্য খুঁজে নিতে হবে।