সারাক্ষণ রিপোর্ট
ঢাকার অলিগলি ঘুরে রিকশা চালান আব্দুল কাদের। সকাল সাতটায় শুরু করে রাত আটটা পর্যন্ত চলে তাঁর সংগ্রামের পথ। আগে দিনে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত আয় করতেন। এখন তা নেমে এসেছে ৩০০ থেকে ৬০০ টাকায়। ‘মেট্রোরেল আসার পর অনেক যাত্রী কমে গেছে ভাই। আগে অফিস টাইমে যাইতে পারতাম বনানী, গুলশান, এখন রিকশা ঢুকতেই দেয় না।” — বলছিলেন কাদের।
এ এক নিঃশব্দ ধস, যেটা শুরু হয়েছে ২০২৩ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় থেকে এবং যা আরও গভীর হয়েছে ২০২৪ ও ২০২৫ সালে।
রিকশাচালকদের আয়: সময়ের সাথে পরিবর্তন
- ২০২৩:
দিনে আয় হতো গড়ে ৮০০–১০০০ টাকা। তবে হরতাল-অবরোধের সময় আয় নেমে যেত ২০০–৩০০ টাকায়। - ২০২৪ সালের প্রথম ৩ মাস:
মেট্রোরেল সম্প্রসারণের পর, বিশেষ করে উত্তরা-মতিঝিল রুট চালু হলে রিকশার যাত্রী অনেক কমে যায়। - ২০২৫ সালের বর্তমান সময়:
অধিকাংশ চালক দিনে আয় করছেন মাত্র ৩০০–৬০০ টাকা, যা দিয়ে চলা কঠিন হয়ে পড়েছে।
রিকশাচালক রশিদ মিয়া জানালেন, “দিনে ৫০০ টাকার বেশি পাই না। এর মধ্যে ২০০ টাকা মালিককে দিতে হয় ভাড়া। বাকি দিয়ে ভাত খাই, তেল কিনি, চাল কিনি, ওষুধ কিনি — বাঁচি কেমনে বলেন?”
আয় কমার কারণ
মেট্রোরেল ও রাস্তায় নিষেধাজ্ঞা:
নগরের উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সড়কে রিকশা নিষিদ্ধ। যাত্রীরা এখন রেল ও বাসে যাচ্ছেন, রিকশার প্রয়োজন কমে গেছে।
ইজিবাইক ও রাইড শেয়ারিংয়ের চাপ:
ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও রাইডশেয়ারিং সার্ভিসের কারণে যাত্রী হারাচ্ছেন সাধারণ রিকশাচালকরা।
অর্থনৈতিক চাপ ও ঋণের ফাঁদ:
অধিকাংশ চালক রিকশা ভাড়া নিয়ে চালান। দিনে ২০০–২৫০ টাকা দিতে হয় মালিককে। আয় কমে যাওয়ায় অনেকে খাবার কেনার টাকাও পান না। প্রায় ৫৭% চালক আয়ের ঘাটতিতে থাকেন এবং ধার করে দিন চালান।
স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অপুষ্টি:
শারীরিক পরিশ্রমের কাজ হলেও অধিকাংশ চালকের পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার সামর্থ্য নেই। অনেকেই দীর্ঘদিন চিকিৎসা না করেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এক নজরে রিকশাচালকের জীবনের চিত্র
- প্রতিদিন কাজ: গড়ে ৭-৮ ঘণ্টা, সপ্তাহে ৭ দিন।
- বাসস্থান: অধিকাংশ বস্তিতে বা যৌথভাবে ভাড়া বাসায় থাকেন।
- সঞ্চয়: মাত্র ২৪% চালকের কোনো সঞ্চয় আছে; গড়ে আয় থেকে ৩% সঞ্চয় করেন।
- ঋণ: ৫৭% চালক ধার করে জীবন চালান।
সমাধানের প্রস্তাব
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার রিকশাচালকদের জীবনমান উন্নয়নে নিতে হবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ:
- রিকশা চলাচলের জন্য আলাদা লেন বা অনুমোদিত রুট নিশ্চিত করা।
- ভর্তুকিসহ স্বল্পসুদে ঋণ ও সঞ্চয় প্রকল্প চালু করা।
- স্বাস্থ্যসেবা সহজপ্রাপ্য ও বিনামূল্যে প্রদান।
- বিকল্প পেশার জন্য প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার ব্যবস্থা।
রিকশাচালক সেলিম জানালেন, “সরকার যদি আমাদের একটা ছোট ঋণ দিত, একটা নিজস্ব রিকশা কিনতে পারতাম। অন্তত প্রতিদিনের ২০০ টাকা ভাড়া দিতে হতো না।”
ঢাকার রিকশাচালকরা আজ আর শুধু শ্রমজীবী নয় — তাঁরা নগর উন্নয়নের ক্ষতিগ্রস্ত নীরব যোদ্ধা। শহরের দ্রুত রূপান্তরের মধ্যেও তাঁদের অস্তিত্ব যেন মুছে না যায়, সেজন্য প্রয়োজন বাস্তবসম্মত, মানবিক পরিকল্পনা।