ট্রেলারের এক ঝলকে জন্ম নেয় বিতর্ক
‘ঠাগ লাইফ’-এর ট্রেলারে কামাল হাসানকে অভিনেত্রী অভিরামীর সঙ্গে এক চুম্বনের দৃশ্য এবং তৃষার সঙ্গে প্রেমের সংলাপ আদান-প্রদানে দেখা যায়। মাত্র দুই মিনিটের ট্রেলারে এসব দৃশ্য খুবই স্বল্প সময়ের জন্য দেখা গেলেও তা নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। প্রশ্ন উঠেছে, কামাল হাসানের বয়স ৭০—তাহলে এত কম বয়সী সহ-অভিনেত্রীদের সঙ্গে রোমান্স কি গ্রহণযোগ্য?
বয়সের ব্যবধান বনাম শিল্পের স্বাধীনতা
অনেকেই এই বয়সের ব্যবধান নিয়ে আপত্তি জানালেও কেউ কেউ বলছেন, যদি গল্পে এমন সম্পর্কের প্রয়োজন থাকে, তাহলে বয়স বিবেচনা না করেই অভিনেতারা সেই চরিত্রে অভিনয় করতে পারেন।
চলচ্চিত্র সমালোচক এ. চন্দ্রশেখর মনে করেন, “এ প্রশ্ন কামাল হাসানকে নয়, পরিচালক মণি রত্নমকে করা উচিত। পরিচালক যখন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এমন চরিত্রে কামালকে কাস্ট করেন, তখন সেটি তার সৃষ্টিশীল সিদ্ধান্ত।”
চন্দ্রশেখর মনে করিয়ে দেন, অভিরামী কামালের বিপরীতে আগেও ‘ভিরুমান্ডি’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন, তখনও বয়সের ব্যবধান ছিল কিন্তু এত বিতর্ক হয়নি। তার ভাষায়, “শুধু বয়স বাড়ল বলে কেউ একটি নির্দিষ্ট চরিত্রে অভিনয় করতে পারবেন না—এমন কোনো নিয়ম নেই।”
ভারতীয় সিনেমায় বয়সের ব্যবধান সাধারণ ঘটনা
চন্দ্রশেখর আরও উদাহরণ দেন—সালমান খানের ‘সিকান্দার’ ছবিতে ৫৯ বছর বয়সী সালমানের বিপরীতে ছিলেন ২৯ বছর বয়সী রাশ্মিকা মান্দানা। ‘পদযোত্তম’-এ মম্মুটি অভিনয় করেন মোহনলালের বাবার চরিত্রে, যদিও বাস্তবে বয়সের পার্থক্য ততটা বেশি নয়। ‘প্রিন্স অ্যান্ড ফ্যামিলি’ ছবিতে বিন্দু পানিক্কার দিলীপের মা হয়েছেন, যদিও তাদের বয়স প্রায় সমান। কভিয়ূর পন্নম্মাও এক সময় অনেক বেশি বয়সী অভিনেতার মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
“এসব কাস্টিং যখন মেনে নেওয়া হয়েছে, তখন ‘ঠাগ লাইফ’-এ কামালের কাস্টিং নিয়ে এত প্রশ্ন কেন?”—জানান চন্দ্রশেখর।
রোমান্টিক দৃশ্য কি বাদ দেওয়া যেত?
এই বিতর্কের মধ্যে চুম্বনের দৃশ্য বাদ দেওয়া যেত কি না—এমন প্রশ্নে চন্দ্রশেখর বলেন, “কিছু অভিনেতা অনন্য। তাদের প্রতিস্থাপন করা যায় না। কামাল হাসান তেমনই একজন, তাই হয়তো চরিত্রটি তার জন্যই উপযুক্ত মনে করেছেন পরিচালক।”
কেবল কামাল নয়, আরও অনেকেই একই পরিস্থিতির মুখে
কামাল হাসানের ক্ষেত্রে যা ঘটছে, তা নতুন কিছু নয়। মম্মুটির সঙ্গে ‘ররশাক’-এ গ্রেস অ্যান্টনি অভিনয় করায় একই বিতর্ক হয়েছিল। মোহনলালও তার ক্যারিয়ারে বহু কম বয়সী নায়িকার সঙ্গে অভিনয় করেছেন, কিন্তু সেসব নিয়ে এমন প্রশ্ন উঠেনি।
সময় বদলেছে, বদলেছে মূল্যায়ন
এক সময়ের স্বাভাবিক কাস্টিং আজ বেশি সমালোচিত। কেউ কেউ এই জুটিগুলোকে সিনেমার গল্পের অংশ হিসেবে মেনে নিলেও অন্যরা তা সমস্যাজনক মনে করেন। সফলতা এখন নির্ভর করছে পরিচালক কীভাবে চরিত্র বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন তার উপর।
চন্দ্রশেখর বলেন, “সিনেমা হলো কল্পনার জগৎ। পরিচালকের কাস্টিং পছন্দ তার সৃজনশীল অধিকার। যদি সেটা বিশ্বাসযোগ্য হয়, তবে কাজ করে। দশ বছর আগে এমন বয়সের ব্যবধানের কাস্টিং হয়তো পুরোপুরি প্রত্যাখ্যাত হতো। এখন আবার দেখা যাচ্ছে পুরনো যুগলের পুনর্মিলন—যেমন শোভনা ও মোহনলাল ‘থুদারুম’ ছবিতে। অভিনয় ও কাস্টিং এক নতুন ধাপে পৌঁছেছে।”
‘ফ্যালোসেন্ট্রিক’ দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা
চিত্রনাট্যকার ডিডি দমোদরন বলেন, “৭০ বছরের একজন অভিনেতার সঙ্গে ৪১ বছর বয়সী একজন অভিনেত্রীর রোমান্সকে সমস্যা হিসেবে দেখা মানে বয়সভিত্তিক চিন্তার প্রতিফলন। সিনেমায় দীর্ঘদিন ধরেই পুরুষদের কেন্দ্র করে গল্প তৈরি হয়েছে—যেখানে নায়ককে সবসময় তরুণ দেখানোর চেষ্টা চলে।”
ডিডির মতে, আসল সমস্যা হলো খুব অল্প বয়সী ও অনভিজ্ঞ অভিনেত্রীদের বেছে নেওয়া, যেখানে তাদের উপস্থাপন করা হয় নিষ্পাপ ও নিয়ন্ত্রণহীন হিসেবে। এ চর্চা থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি।
তিনি জানান, সময় বদলাচ্ছে। তৃষা ও নয়নতারার মতো অভিনেত্রীরা এখন সম্মান ও প্রভাবের প্রতীক হিসেবে উঠে এসেছেন—যা পুরনো ধারার বিপরীত।
নারী ও পুরুষ অভিনেতার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির বৈষম্য
ডিডি বলেন, “পুরুষদের চেহারা বা বয়স নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় না, কারণ তাদের ‘চিরতরুণ নায়ক‘ ইমেজ ধরে রাখার চাপ রয়েছে। বিপরীতে, নায়িকারা বিয়ের পর ‘আকর্ষণ’ হারান—এ ধারণা ছড়িয়ে পড়ায় অনেকেই পর্দা থেকে দূরে সরে যান। এই বৈষম্যটাই সমস্যার মূল।”
‘দ্য রিডার’ ছবির প্রসঙ্গ তুলে ডিডি জানান, সেখানে কেট উইন্সলেটের সঙ্গে এক কিশোর ছেলের রোমান্সে বিতর্ক হয়—যা প্রমাণ করে বয়স ও লিঙ্গ ভেদে দর্শকের প্রতিক্রিয়া কেমন ভিন্ন।
‘বয়স কোনো বাধা নয় অভিনয়ে’
ডিডি বলেন, “চরিত্র যদি বয়সবিশিষ্ট হয়, তাহলে সেই বয়সী অভিনেতাকে নিয়েই অভিনয় হওয়া উচিত। যেমন ক্লিন্ট ইস্টউড ও মেরিল স্ট্রিপের ‘দ্য ব্রিজেস অফ ম্যাডিসন কাউন্টি’ ছবিতে আমরা পরিপক্ব প্রেমের গল্প দেখেছি। সেখানেও অনেকে ইস্টউডকে ‘বয়সের ভারে ক্লান্ত’ বললেও, তিনি নিজের অভিনয় দিয়ে তা ভুল প্রমাণ করেন। ৭০ বছর বয়সী অভিনেতা একটি চুম্বনের দৃশ্য করলেই তা বিতর্কিত হবে কেন? বয়স অভিনয়ের সীমা নয়।”
শেষে ডিডি বলেন, “পুরুষরা যখন বিবাহিত বা প্রবীণ হয়েও নানান চরিত্রে অভিনয় করেন, তখন কেউ প্রশ্ন তোলে না। কিন্তু নায়িকারা বয়স বা বৈবাহিক অবস্থার কারণে ‘মার্কেট ভ্যালু’ হারান বলে ধরে নেওয়া হয়। এটাই আসল সাংস্কৃতিক সংকট, যেটা আমাদের বদলাতে হবে।”