১০:১৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫
ভুটানের সিংগাপুর ‘মাইন্ডফুলনেস সিটি’ কি তার যুবসমাজকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারবে? পাকিস্তানের সংবিধানে ২৭তম সংশোধনীর প্রভাব: কারাবন্দি ইমরান খানের ভবিষ্যৎ শেখ হাসিনার মামলার রায় আজ ইউটিউব থেকে উধাও শত শত এআই–তৈরি বলিউড ভিডিও, নতুন করে আলোচনায় তারকাদের ডিজিটাল অধিকার পানীয়ের সঙ্গে কী খাবেন গ্রে’স অ্যানাটমি’ তারকা জেমস পিকেন্স জুনিয়রের প্রোস্টেট ক্যান্সার ধরা, স্ক্রিনিংয়ের আহ্বান এআই–তৈরি নায়িকা নিয়ে নতুন দুশ্চিন্তায় হলিউড অ্যানিমেটেড কে–পপ মুভিই প্রথমবার নেটফ্লিক্সকে দিল উত্তর আমেরিকার বক্স অফিসে শীর্ষস্থান চীনা অনলাইন সাহিত্য, গেম, অ্যানিমেশন ও পপ কালচারের স্বতঃস্ফূর্ত বিস্তার কীভাবে দেশের সফট পাওয়ারকে বদলে দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের পুনরায় ভারতে কার্যক্রম শুরু করায় শক্তিশালী আয়: সাপ্তাহিক লাভে ভারতীয় শেয়ারবাজার

ঢাকায় ঈদুল আজহার বিলুপ্তপ্রায় উৎসব ও সামাজিক রীতি (পর্ব-৪)

ঈদুল আজহা এখন অনেকটাই কোরবানির নির্দিষ্ট আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। কিন্তু ঢাকার ঐতিহ্যে এই ঈদের সঙ্গে যুক্ত ছিল আরও বহু আয়োজন, রীতি, খেলা, ও সামাজিক মিলনমেলা—যেগুলো একসময় পাড়ার সব বয়সী মানুষেরা উপভোগ করতেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সব আয়োজন হারিয়ে যেতে বসেছে, নতুন প্রজন্ম জানেও না সে ঐতিহ্যের কথা। এই পর্বে সেইসব হারানো সংস্কৃতির অনুসন্ধানই তুলে ধরা হলো।

১. ঈদের পরদিনের শোভাযাত্রা ও ফানুস মিছিল

একসময় ঢাকায় ঈদের পরদিন বিকেলে শিশু-কিশোর ও যুবকদের উদ্যোগে হতো শোভাযাত্রা বা ফানুস মিছিল। পুরান ঢাকার সূত্রাপুর, বংশাল, নাজিমুদ্দিন রোড, কেরানীগঞ্জ এলাকায় ছেলেরা রঙিন কাগজ দিয়ে তৈরি ফানুস হাতে মিছিল করত।

এগুলোতে থাকত ছোট ব্যানার, টিনের বাজনা, কখনো রিকশায় চড়া ‘গরু রাজা’ বা হাস্যরসাত্মক চরিত্র। শোভাযাত্রা শেষে হতো পাড়ার সবচেয়ে বড় মাঠে বা খোলা প্রাঙ্গণে সবাই মিলে ফানুস ওড়ানো বা ছোট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বর্তমানে এই রীতিটি প্রায় পুরোপুরি বিলুপ্ত।

২. গরু রেস’ ও গরুর সাজ প্রতিযোগিতা

ঈদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিন ঢাকার শহরতলি ও পুরান ঢাকা সংলগ্ন এলাকায় হতো গরু দৌড় প্রতিযোগিতা। এতে গ্রামের খামারিরা তাদের কোরবানির গরুদের নিয়ে আসত সাজিয়ে-গুজিয়ে এবং একটা নির্ধারিত রুটে দৌড় প্রতিযোগিতা হতো। দর্শকেরা করত উল্লাস, জেতা গরুর মালিক পেত পুরস্কার।

এর পাশাপাশি কিছু এলাকায় আয়োজন করা হতো গরু সাজানোর প্রতিযোগিতা। গলায় ফুলের মালা, রঙিন চাদর, গায়ে আলপনা দিয়ে গরুকে সাজানো হতো, আর বিচারকরা সেই সাজের ভিত্তিতে পুরস্কার দিত। আজ তা শুধু ইতিহাসের পাতায়।

৩. ঈদের ছুটিতে ছাদ নাটক’ বা মহল্লার নাট্যউৎসব

৮০ ও ৯০-এর দশকে ঢাকার অনেক মহল্লায় ঈদের ছুটিতে স্থানীয় যুবকরা আয়োজন করত ছাদ নাটক। কোনো ভবনের ছাদে, স্কুল মাঠে বা পাড়ার ক্লাবঘরে হতো ছোট নাট্যউৎসব। ছেলেমেয়েরা নিজ হাতে স্ক্রিপ্ট লিখত, মঞ্চ বানাত, প্রপস তৈরি করত।

নাটক হতো হাস্যরসাত্মক বা সামাজিক বার্তা ভিত্তিক। দর্শকেরা পরিবার নিয়ে ছুটে আসত, পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও গল্প হতো। বর্তমানে সেসব নাট্যচর্চা কমে গিয়ে স্থান দখল করেছে ইউটিউব, ফেসবুক আর অনলাইন স্ট্রিমিং।

৪. কোরবানির গল্প শোনানো ও বয়স্কদের আড্ডা

একসময় ঢাকার পাড়ায় পাড়ায় ঈদের দিন বিকেলে বড়রা উঠোনে বা বারান্দায় বসে কোরবানির পেছনের ধর্মীয় ইতিহাস, হজের রেওয়াজ, আরব দেশের কোরবানি রীতি এসব গল্প করতেন ছোটদের সঙ্গে। এতে ঈদের ধর্মীয় তাৎপর্য ও ঐতিহ্য প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়ত।

আজ অনেকটাই এই ‘বয়স্ক বয়ান’ হারিয়ে গেছে। এখন অনেক বাড়িতেই বড়দের কোরবানি হয়ে গেলেও শিশুদের সঙ্গে সে বিষয়ে ধর্মীয় আলোচনা হয় না।

৫. পাড়ার গরুর হাট মেলা’ বা পাবলিক দুধ বিতরণ

ঢাকার কিছু এলাকায় একসময় গরু কোরবানির পরে বা আগের দিন দুধ বিতরণ করা হতো পাড়ার সকলের মাঝে। বিশেষ করে দুধেল গাভী থাকলে সেখান থেকে সংগ্রহ করা দুধ শিশুসহ প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে পৌঁছানো হতো। এই কাজটি ‘পাবলিক দুধ’ নামে পরিচিত ছিল।

একইভাবে, অনেক এলাকায় গরুর হাটের পাশে লাগানো হতো মেলা—যেখানে থাকত খেলনা, খাবার, ও হাতের কাজ বিক্রি। নারী-শিশুরা আলাদাভাবে যেত সেই মেলায়। আজকের ঢাকায় পশুর হাট শুধু বেচাকেনার কেন্দ্রে রূপ নিয়েছে, সেই উৎসব ভাব আর নেই।

৬. মেয়েদের ঈদ রীতি’: হস্তশিল্পমেহেদি ও ঈদ নৃত্য

অনেক পরিবারে ঈদের পরদিন বাচ্চা মেয়েরা ও কিশোরীরা করত হস্তশিল্প প্রতিযোগিতা—কাগজে আলপনা আঁকা, কাগজ দিয়ে গরুর অবয়ব বানানো, ঘরে তৈরি রঙ দিয়ে রুম সাজানো। কেউ কেউ আয়োজিত নাচ বা কোরিওগ্রাফ করা ছোট অনুষ্ঠান করত পরিবারের সদস্যদের সামনে।

এইসব ছোট আয়োজন মেয়েদের ঈদে সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করত। কিন্তু এখন এসব জায়গা দখল করে নিয়েছে মোবাইল গেম, সোশ্যাল মিডিয়া, কিংবা পরিবারের বাইরে যাওয়া।

পুরনো ঐতিহ্যের অবলুপ্তির কারণ

এইসব আয়োজন আজ হারিয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন:

  • নগরায়ন ও বাসাবদলের ফলে পাড়ার বন্ধন দুর্বল হওয়া
  • সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভার্চুয়াল মগ্নতা
  • ঈদের ব্যস্ততা সীমিত হওয়া শুধু কোরবানি ও আত্মীয়দের খাওয়াদাওয়ায়
  • মাঠ, খোলা জায়গা ও ছাদ ব্যবহারের সংকোচন

তবুও পুরান ঢাকার কিছু পরিবার এবং শহরতলির কিছু যুব সমাজ এখনো ঐতিহ্য রক্ষায় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

জনপ্রিয় সংবাদ

ভুটানের সিংগাপুর ‘মাইন্ডফুলনেস সিটি’ কি তার যুবসমাজকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারবে?

ঢাকায় ঈদুল আজহার বিলুপ্তপ্রায় উৎসব ও সামাজিক রীতি (পর্ব-৪)

০৭:০০:১৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ৭ জুন ২০২৫

ঈদুল আজহা এখন অনেকটাই কোরবানির নির্দিষ্ট আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। কিন্তু ঢাকার ঐতিহ্যে এই ঈদের সঙ্গে যুক্ত ছিল আরও বহু আয়োজন, রীতি, খেলা, ও সামাজিক মিলনমেলা—যেগুলো একসময় পাড়ার সব বয়সী মানুষেরা উপভোগ করতেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সব আয়োজন হারিয়ে যেতে বসেছে, নতুন প্রজন্ম জানেও না সে ঐতিহ্যের কথা। এই পর্বে সেইসব হারানো সংস্কৃতির অনুসন্ধানই তুলে ধরা হলো।

১. ঈদের পরদিনের শোভাযাত্রা ও ফানুস মিছিল

একসময় ঢাকায় ঈদের পরদিন বিকেলে শিশু-কিশোর ও যুবকদের উদ্যোগে হতো শোভাযাত্রা বা ফানুস মিছিল। পুরান ঢাকার সূত্রাপুর, বংশাল, নাজিমুদ্দিন রোড, কেরানীগঞ্জ এলাকায় ছেলেরা রঙিন কাগজ দিয়ে তৈরি ফানুস হাতে মিছিল করত।

এগুলোতে থাকত ছোট ব্যানার, টিনের বাজনা, কখনো রিকশায় চড়া ‘গরু রাজা’ বা হাস্যরসাত্মক চরিত্র। শোভাযাত্রা শেষে হতো পাড়ার সবচেয়ে বড় মাঠে বা খোলা প্রাঙ্গণে সবাই মিলে ফানুস ওড়ানো বা ছোট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বর্তমানে এই রীতিটি প্রায় পুরোপুরি বিলুপ্ত।

২. গরু রেস’ ও গরুর সাজ প্রতিযোগিতা

ঈদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিন ঢাকার শহরতলি ও পুরান ঢাকা সংলগ্ন এলাকায় হতো গরু দৌড় প্রতিযোগিতা। এতে গ্রামের খামারিরা তাদের কোরবানির গরুদের নিয়ে আসত সাজিয়ে-গুজিয়ে এবং একটা নির্ধারিত রুটে দৌড় প্রতিযোগিতা হতো। দর্শকেরা করত উল্লাস, জেতা গরুর মালিক পেত পুরস্কার।

এর পাশাপাশি কিছু এলাকায় আয়োজন করা হতো গরু সাজানোর প্রতিযোগিতা। গলায় ফুলের মালা, রঙিন চাদর, গায়ে আলপনা দিয়ে গরুকে সাজানো হতো, আর বিচারকরা সেই সাজের ভিত্তিতে পুরস্কার দিত। আজ তা শুধু ইতিহাসের পাতায়।

৩. ঈদের ছুটিতে ছাদ নাটক’ বা মহল্লার নাট্যউৎসব

৮০ ও ৯০-এর দশকে ঢাকার অনেক মহল্লায় ঈদের ছুটিতে স্থানীয় যুবকরা আয়োজন করত ছাদ নাটক। কোনো ভবনের ছাদে, স্কুল মাঠে বা পাড়ার ক্লাবঘরে হতো ছোট নাট্যউৎসব। ছেলেমেয়েরা নিজ হাতে স্ক্রিপ্ট লিখত, মঞ্চ বানাত, প্রপস তৈরি করত।

নাটক হতো হাস্যরসাত্মক বা সামাজিক বার্তা ভিত্তিক। দর্শকেরা পরিবার নিয়ে ছুটে আসত, পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও গল্প হতো। বর্তমানে সেসব নাট্যচর্চা কমে গিয়ে স্থান দখল করেছে ইউটিউব, ফেসবুক আর অনলাইন স্ট্রিমিং।

৪. কোরবানির গল্প শোনানো ও বয়স্কদের আড্ডা

একসময় ঢাকার পাড়ায় পাড়ায় ঈদের দিন বিকেলে বড়রা উঠোনে বা বারান্দায় বসে কোরবানির পেছনের ধর্মীয় ইতিহাস, হজের রেওয়াজ, আরব দেশের কোরবানি রীতি এসব গল্প করতেন ছোটদের সঙ্গে। এতে ঈদের ধর্মীয় তাৎপর্য ও ঐতিহ্য প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়ত।

আজ অনেকটাই এই ‘বয়স্ক বয়ান’ হারিয়ে গেছে। এখন অনেক বাড়িতেই বড়দের কোরবানি হয়ে গেলেও শিশুদের সঙ্গে সে বিষয়ে ধর্মীয় আলোচনা হয় না।

৫. পাড়ার গরুর হাট মেলা’ বা পাবলিক দুধ বিতরণ

ঢাকার কিছু এলাকায় একসময় গরু কোরবানির পরে বা আগের দিন দুধ বিতরণ করা হতো পাড়ার সকলের মাঝে। বিশেষ করে দুধেল গাভী থাকলে সেখান থেকে সংগ্রহ করা দুধ শিশুসহ প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে পৌঁছানো হতো। এই কাজটি ‘পাবলিক দুধ’ নামে পরিচিত ছিল।

একইভাবে, অনেক এলাকায় গরুর হাটের পাশে লাগানো হতো মেলা—যেখানে থাকত খেলনা, খাবার, ও হাতের কাজ বিক্রি। নারী-শিশুরা আলাদাভাবে যেত সেই মেলায়। আজকের ঢাকায় পশুর হাট শুধু বেচাকেনার কেন্দ্রে রূপ নিয়েছে, সেই উৎসব ভাব আর নেই।

৬. মেয়েদের ঈদ রীতি’: হস্তশিল্পমেহেদি ও ঈদ নৃত্য

অনেক পরিবারে ঈদের পরদিন বাচ্চা মেয়েরা ও কিশোরীরা করত হস্তশিল্প প্রতিযোগিতা—কাগজে আলপনা আঁকা, কাগজ দিয়ে গরুর অবয়ব বানানো, ঘরে তৈরি রঙ দিয়ে রুম সাজানো। কেউ কেউ আয়োজিত নাচ বা কোরিওগ্রাফ করা ছোট অনুষ্ঠান করত পরিবারের সদস্যদের সামনে।

এইসব ছোট আয়োজন মেয়েদের ঈদে সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করত। কিন্তু এখন এসব জায়গা দখল করে নিয়েছে মোবাইল গেম, সোশ্যাল মিডিয়া, কিংবা পরিবারের বাইরে যাওয়া।

পুরনো ঐতিহ্যের অবলুপ্তির কারণ

এইসব আয়োজন আজ হারিয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন:

  • নগরায়ন ও বাসাবদলের ফলে পাড়ার বন্ধন দুর্বল হওয়া
  • সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভার্চুয়াল মগ্নতা
  • ঈদের ব্যস্ততা সীমিত হওয়া শুধু কোরবানি ও আত্মীয়দের খাওয়াদাওয়ায়
  • মাঠ, খোলা জায়গা ও ছাদ ব্যবহারের সংকোচন

তবুও পুরান ঢাকার কিছু পরিবার এবং শহরতলির কিছু যুব সমাজ এখনো ঐতিহ্য রক্ষায় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।