১২:২৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৩৩ তম কিস্তি )

  • Sarakhon Report
  • ১২:০০:৩১ অপরাহ্ন, বুধবার, ১০ এপ্রিল ২০২৪
  • 39

 

রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো। ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না।

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।

দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।

দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।

দিবা রাত্রির কাব্য

মানিক বন্দোপাধ্যায়

 

‘জানিস্ বই কি। তবু বললাম। রাগিস্নে। তোকে তো গোড়াতেই বলেছি, আমার ছিল না এমন অনেক স্বভাব ইতিমধ্যে আমি অর্জন করে ফেলেছি। বাহুল্য কথা বলা তার মধ্যে একটা।’

কথা, কথা, কথা। শুধু কথা পাকানো, কথা মোচড়ানো, কথা নিয়ে লড়াই করা। সুপ্রিয়া মাথা নত করল। এত কথা কি জন্ম? পরিচয়ের জন্ম নয়, উদ্দেশ্য নির্ণয়ের জন্য নয়, সময় কাটানোর জন্যও নয়। পরিচয় তাদের যা আছে আর তা বাড়বে না, পরস্পরের উদ্দেশ্য সম্বন্ধেও ভুল হবার তাদের কোন কারণ নেই, কথা না বললেও তাদের সময় কাটবে। তবু প্রাণপণে।

তারা কথা বলছে। চিরকাল এমনভাবে মানুষ কত কথা বলতে পারে? আজও অনিশ্চয়তা বজায় থাকার অভিমানে সুপ্রিয়া কথা বন্ধ রাখল। হেরম্ব চুপ করল বক্তব্যের অভাবে। একথা মিথ্যা নয় যে, কথা নিয়ে লড়াই করাটাই চরম উদ্দেশ্য দাঁড়িয়ে গেছে বলে সুপ্রিয়াকে বলার তার কিছুই নেই।

কাছাকাছি বসে এমনিভাবে পরের মতো তারা চিন্তা করছে, আনন্দ ঘরে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার কাছে টাকা আছে? দশটা টাকা দিতে

পারবে?’

‘টাকা কি হবে আনন্দ?’

‘বাবা চাইল।’

হেরম্ব অবাক হয়ে গেল। ‘মাস্টারমশাই টাকা চাইলেন? টাকা দিয়ে

তিনি কি করবেন?’

আনন্দ এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না। সে জানে না। সে চলে গেলে হেরম্ব চেয়ে দেখল সুপ্রিয়া খুব সরলভাবে অত্যন্ত টাকা নিয়ে কুটিল হাসি হাসছে। আনন্দের সঙ্গে হেরম্বের আর্থিক সম্পর্কটি আবিষ্কার করা মাত্র তার যেন আর কিছু বুঝতে বাকি নেই। এতক্ষণে সেই নির্ভয় ও নিশ্চিন্ত হল। প্রতিবাদ করতে গিয়ে হেরম্ব চুপ করে গেল। প্রতিবাদ শুধু নিষ্ফল নয়, অশোভন।

সুপ্রিয়া উঠে দাঁড়াল। হাসিমুখে বলল, ‘বাড়ি পৌঁছে দেবেন না?’ ‘এখুনি যাবি?’

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৩৩ তম কিস্তি )

১২:০০:৩১ অপরাহ্ন, বুধবার, ১০ এপ্রিল ২০২৪

 

রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো। ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না।

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।

দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।

দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।

দিবা রাত্রির কাব্য

মানিক বন্দোপাধ্যায়

 

‘জানিস্ বই কি। তবু বললাম। রাগিস্নে। তোকে তো গোড়াতেই বলেছি, আমার ছিল না এমন অনেক স্বভাব ইতিমধ্যে আমি অর্জন করে ফেলেছি। বাহুল্য কথা বলা তার মধ্যে একটা।’

কথা, কথা, কথা। শুধু কথা পাকানো, কথা মোচড়ানো, কথা নিয়ে লড়াই করা। সুপ্রিয়া মাথা নত করল। এত কথা কি জন্ম? পরিচয়ের জন্ম নয়, উদ্দেশ্য নির্ণয়ের জন্য নয়, সময় কাটানোর জন্যও নয়। পরিচয় তাদের যা আছে আর তা বাড়বে না, পরস্পরের উদ্দেশ্য সম্বন্ধেও ভুল হবার তাদের কোন কারণ নেই, কথা না বললেও তাদের সময় কাটবে। তবু প্রাণপণে।

তারা কথা বলছে। চিরকাল এমনভাবে মানুষ কত কথা বলতে পারে? আজও অনিশ্চয়তা বজায় থাকার অভিমানে সুপ্রিয়া কথা বন্ধ রাখল। হেরম্ব চুপ করল বক্তব্যের অভাবে। একথা মিথ্যা নয় যে, কথা নিয়ে লড়াই করাটাই চরম উদ্দেশ্য দাঁড়িয়ে গেছে বলে সুপ্রিয়াকে বলার তার কিছুই নেই।

কাছাকাছি বসে এমনিভাবে পরের মতো তারা চিন্তা করছে, আনন্দ ঘরে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার কাছে টাকা আছে? দশটা টাকা দিতে

পারবে?’

‘টাকা কি হবে আনন্দ?’

‘বাবা চাইল।’

হেরম্ব অবাক হয়ে গেল। ‘মাস্টারমশাই টাকা চাইলেন? টাকা দিয়ে

তিনি কি করবেন?’

আনন্দ এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না। সে জানে না। সে চলে গেলে হেরম্ব চেয়ে দেখল সুপ্রিয়া খুব সরলভাবে অত্যন্ত টাকা নিয়ে কুটিল হাসি হাসছে। আনন্দের সঙ্গে হেরম্বের আর্থিক সম্পর্কটি আবিষ্কার করা মাত্র তার যেন আর কিছু বুঝতে বাকি নেই। এতক্ষণে সেই নির্ভয় ও নিশ্চিন্ত হল। প্রতিবাদ করতে গিয়ে হেরম্ব চুপ করে গেল। প্রতিবাদ শুধু নিষ্ফল নয়, অশোভন।

সুপ্রিয়া উঠে দাঁড়াল। হাসিমুখে বলল, ‘বাড়ি পৌঁছে দেবেন না?’ ‘এখুনি যাবি?’