২১ জুন ২০২৫, শনিবার। রাজধানী ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন বাজারে ঘুরে দেখা গেল এক অস্বস্তিকর বাস্তবতা—বছরের এই সময়টায় যখন নতুন বোরো ধান বাজারে আসে, তখন চালের দাম কিছুটা কম থাকার কথা। অথচ বাস্তবতা ঠিক উল্টো। মিনিকেট চাল থেকে শুরু করে মোটা চাল পর্যন্ত—সব ধরনের চালের দাম গত দুই সপ্তাহে কেজিতে ৬ থেকে ৮ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। এই দামবৃদ্ধি শুধু মধ্যবিত্ত নয়, নিম্নআয়ের মানুষের পাতে সরাসরি আঘাত হানছে।
ঢাকার বাজারের চিত্র: দাম কত?
শনিবার (২১ জুন) মোহাম্মদপুর, টাউন হল, মিরপুর-৬, কাওরানবাজার ও রামপুরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে—
- মিনিকেট চাল এখন বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮২ টাকা প্রতি কেজি, যেখানে ঈদের আগেও এই দাম ছিল ৭২–৭৪ টাকা।
- নাজিরশাইল ও জিরাশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৭৮ থেকে ৮৫ টাকা কেজি দরে, যার গড় দাম গত বছরের তুলনায় ১০–১২ টাকা বেশি।
- মোটা চাল, যেমন স্বর্ণা বা ব্রি-২৮, বিক্রি হচ্ছে ৫৫–৫৬ টাকা কেজিতে, যা এক মাস আগেও ছিল ৫০–৫১ টাকা।
বিক্রেতারা বলছেন, মিলারদের কাছ থেকে চাল কিনতেই এখন আগের চেয়ে কেজিতে ৫–৬ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। মিল মালিকেরা বলছেন, উৎপাদনস্থলে নতুন বোরো ধানের দাম বেড়ে গেছে, তাই তারা চালের দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন।
দাম বাড়ার কারণ: মিলার, ধান, না কি বাজার সিন্ডিকেট?
ধানের দাম: দেশের প্রধান চাল উৎপাদন অঞ্চলগুলোতে নতুন বোরো ধান উঠলেও আশানুরূপ সরবরাহ হয়নি। কৃষকরা বলছেন, শ্রমিক সংকট, ডিজেল-বিদ্যুতের ব্যয় বৃদ্ধি এবং জলবায়ুজনিত সমস্যার কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। ফলে তারা বেশি দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। তার চাপ পড়ে চালের বাজারে।
মিলারদের ভূমিকা: চালকল মালিকরা বোরো মৌসুমের শুরুতে কিছুটা কম দামে চাল বাজারে ছেড়েছিলেন। কিন্তু ঈদের পর ধানের দাম বাড়ায় তারাও দাম সমন্বয় করছেন। অনেক মিল চাল উৎপাদন কমিয়ে রেখেছে, যা বাজারে চাপ বাড়াচ্ছে।
সিন্ডিকেট সন্দেহ: খুচরা বিক্রেতা ও ভোক্তারা সন্দেহ করছেন, কিছু পাইকারি ব্যবসায়ী ও মিল মালিক মিলে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছেন। তারা চাল মজুদ রেখে দাম বাড়ার অপেক্ষায় রয়েছেন।
নিম্নআয়ের মানুষের কষ্ট: ভাতেই জ্বালা
জিনিসপত্রের দাম যখন হু হু করে বাড়ে, তখন মধ্যবিত্ত কিছুটা মানিয়ে নিতে পারে, কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষের হাতে সে সুযোগ থাকে না। স্বর্ণা চাল খাওয়া সাধারণ মানুষ এখন কেজিতে ৫–৬ টাকা বেশি দিয়ে চাল কিনছেন। পরিবারপ্রতি মাসে গড়ে ৩০–৪০ কেজি চাল লাগে—এতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে প্রায় ২০০ টাকা। অনেকেই এখন স্বল্পমানের চাল কিংবা পরিমাণে কম কিনছেন। একদিন পরপর রান্না করছেন এমন উদাহরণও পাওয়া গেছে।
মিরপুরের এক রিকশাচালক বলেন, “সারা দিন কষ্ট করে ৭০০–৮০০ টাকা কামাই করি। আগে ৫২ টাকায় স্বর্ণা চাল কিনতাম, এখন লাগে ৫৭ টাকা। বাচ্চা তিনটা আছে। চাল কিনতেই টান পড়ে যায়।”
আন্তর্জাতিক বাজারের চিত্র: দাম কমলেও স্থানীয় প্রভাব নেই
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) এর সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, মে ২০২৫–এ FAO All Rice Price Index ছিল ১০৬.৩ পয়েন্ট, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২২.৬% কম। উৎপাদন বৃদ্ধি, রপ্তানি শুল্ক হ্রাস এবং ভারত, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের বড় রপ্তানির কারণে বিশ্ববাজারে চালের দাম স্থিতিশীল।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ USDA জানিয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিশ্বে চাল উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ৫৪১.৬ মিলিয়ন টন, এবং মজুদ প্রায় ১৭৭ মিলিয়ন টন। অর্থাৎ বিশ্বে চালের ঘাটতি নেই।
তাহলে প্রশ্ন হলো—বাংলাদেশে দাম বাড়ছে কেন?
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্ববাজারের মূল্য স্থিতিশীল হলেও স্থানীয় বাজারে সিন্ডিকেট, সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং আমদানি নীতির ধীরগতি—এই তিনটি বড় কারণ।
সরকারের ভূমিকা কোথায়?
সরকার ইতোমধ্যে ওএমএস (Open Market Sale) ও টিসিবি–এর মাধ্যমে সুলভ মূল্যে চাল বিক্রি শুরু করলেও সেটি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জরুরি ভিত্তিতে যা করা উচিত—
চাল আমদানিতে শুল্ক হ্রাস: প্রয়োজন হলে স্বল্পমেয়াদি ভিত্তিতে চাল আমদানি করে বাজারে সরবরাহ বাড়াতে হবে।
মজুদ নিয়ন্ত্রণ আইন প্রয়োগ: সিন্ডিকেট ও কৃত্রিম সংকট রোধে কঠোর নজরদারি চালাতে হবে।
টিসিবি–এর কার্যক্রম বাড়ানো: নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে সুলভ মূল্যে চাল পৌঁছে দিতে হবে।
চালের দামে আগুন, নিভবে কখন?
চাল বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য। তাই এর দাম বাড়া মানে শুধু ভাতের সমস্যা নয়—এটি পুরো পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তা, বাজেট ও জীবনের মানের ওপর প্রভাব ফেলে। আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকার পরও স্থানীয় বাজারে যদি চালের দাম এমনভাবে বেড়ে যায়, তাহলে এটি প্রশাসনিক ব্যর্থতা হিসেবেই গণ্য হবে।
এই মুহূর্তে দরকার তাত্ক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ—যার মাধ্যমে বাজারে চালের সরবরাহ ও দাম দুটোই স্থিতিশীল রাখা যায়। না হলে ভাতের হাঁড়ি ছোট হবে আর মানুষের ক্ষুধা আরও বড় হয়ে উঠবে।