জোনাকি
বলতেন, আর হই ক’রে কাঁদতেন। কাঁদতেও ভালো লাগতো। মনে হতো কতোদিন এমন করে কান্না আসেনি, ক-তো-দি-ন, কতোকাল। সবুজ থালার ওপর নীলরঙের মন্ত ঘাটি উপুড় করা; বাটির ভেতরে শুধু সুগন্ধ, শুধু প্রাণ; এক ফোঁটা কাঁচপোকা কিংবা সামান্য ঝিঁঝিপোকার আনন্দও সেই বিশাল বাটির ভেতরে দেখবার মতো। ছড়ানো, ছিটানো, এলোমেলো, খোলামেলা। এলোমেলো গাছপালার, ঝোপঝাড়, এলোমেলো বাতাস, নিরেট নীরবতার একটিই অর্থ সেখানে-আমার যেমন খুশি আমি সেইভাবে থাকবো। আবুল হোসেন নিজেও তাঁর কান্নাকে বাতাসের মতো, গাছপালার মতো, এলোমেলো করে দিতেন মাঝেমাঝে।
কান্নাকে মনে হতো রমণী, সে ঠিকই তার আড়াল খুঁজে নিতো, হাঁটুপানিতে নেমে আঁচলের খুঁট ভিজিয়ে গাল-গলা ডলতো, খোঁপা খুলে দিতো, তারপর নামতো বুক-সমান পানিতে, শাড়ি খুলে ভাসিয়ে ডুব দিতো। রৌদ্রকে মনে হতো বীর্যবান, বাতাসকে সবুজ: নিস্তব্ধতার যে ভাষা তাহলো এই, নত হও, নত হও, আরো নত হও, নত হলেই গিমেশাক-পুনর্নবা তোমাকে ভালোবাসবে, ছাতারে দেবে তার ডানা থেকে পালক, কাঠঠোকরার উলুধ্বনি, সব পাবে।
বুঝতে পারলেন কাঁধের একটা ধার ব্যথায় চড়চড় করছে। আবুল হোসেন আবার চেষ্টা করলেন গ্রামের চিন্তায় ডুবে যেতে, পারলেন না। অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথা মনে হতে থাকলো তাঁর। একবার ভাবলেন ছুটে গিয়ে নাগার পা ধরে মাপ চেয়ে নেবেন, ওর পক্ষে সেটাই হবে প্রকৃত শাস্তি, আচ্ছামতো জব্দ হবে কুলাঙ্গারটা। একবার ভাবলেন মাপ চেয়ে মরিয়মকে লজ্জায় ফেলে দিলে কেমন হয়! ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু এই সবই ভাবলেন, ভাবলেন এবং মনের সাধ মিটিয়ে নানাভাবে সবাইকে শাস্তি দিলেন, এমন কি কল্পনায় আত্মহত্যা করে সবাইকে কাঁদাতেও তিনি পিছপা হলেন না।
চোখের পাতা প্রায় বুজে এসেছে, এমন সময় বুলু এসে তাঁকে ডাকলো।
বললে, ‘আব্বু চলো, খেয়ে নেবে-‘
আবুল হোসেন বললেন ‘তোমরা?’
‘আগে তুমি চলো-
‘আসছি তুমি যাও!’
‘না, তুমি আমার সঙ্গে চলো’ কান্নায় কেমন যেন ভেজা বুলুর গলার স্বর, সে একটা হাত রাখলো তাঁর গায়ে।
আবুল হোসেন চোখ মেলে দেখলেন। এই প্রথম তাঁর মনে হলো বুলুর হাত কি কোমল, চোখ কি স্নিগ্ধ!