দুই শুয়ে-পড়া বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে হালকা কুয়াশা যখন পাহাড়ের ঢালে গড়িয়ে পড়ে, তখনই প্রথম দেখা মেলে তার—লম্বায় প্রায় পাঁচ মিটার; মাথা তুললেই ছায়া লম্বা হয় আরও। কিং কোবরা, বিশ্বের দীর্ঘতম বিষধর সাপ, এখনও বাংলাদেশের পাহাড়ি বনভূমিতে নিজের নেওয়া রাজসিংহাসন আঁকড়ে আছে। বন উজাড়ে সংকুচিত আবাস, পাচারের ফাঁদ আর লোককথার ভয়ে মোড়া এই সাপটিকে ঘিরে আছে বিস্ময়, ভীতি ও বিজ্ঞান—সবই একসঙ্গে।
পাহাড়ি ছায়ায় গোপন ঘর
চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্টস, কক্সবাজারের ইনানি পাহাড়, সিলেটের লাউয়াছড়া ও সুন্দরবনের উঁচু চর—মোটামুটি এতটুকুই অবশিষ্ট ‘সার্কিট’ কিং কোবরার। বাঁশঝাড়, গাছের গুঁড়ির ফাঁক আর পত্রস্তূপে সে ডিম পাড়ে; স্ত্রী সাপ নিজেই বাসা পাহারা দেয়—সাপজগতে বিরল মাতৃত্বের নজির। বনের ভিজে মাটিতে পায়ের ছাপ খোঁজেন বনপ্রহরী শাহেদুল ইসলাম: “গত পাঁচ বছরে পাহাড়ি ট্রেইলে তিনবার কিং কোবরা দেখেছি, কামড়ের খবর পাইনি,”—তিনি বললেন।
জীববৈচিত্র্যে ‘টপ প্রিডেটর’
কিং কোবরা সাপ খায় সাপই—ধামনা, দড়িসাপ আর কখনও পাইথন। এতে অন্য বিষধর সাপের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে থাকে, ফলে বন-বাসিন্দাদের অজান্তেই মানুষের ঝুঁকি কমে। গবেষণাগারের হিসাব জানায়, এর ১–২ মিলিলিটার বিষ ২০ জন প্রাপ্তবয়স্কের জীবন কেড়ে নিতে পারে। তবু স্বভাব লাজুক; মানুষ দেখলেই পালানোর পথ খোঁজে।
মৌসুমি সতর্কবার্তা
- জানুয়ারি-এপ্রিল—প্রজননকাল। পুরুষদের দ্বন্দ্ব আর স্ত্রী সাপের বাসা পাহারা: তখনই আক্রমণাত্মক রূপ স্পষ্ট।
•জুন-সেপ্টেম্বর—বর্ষা। বনভূমি প্লাবিত হলে উঁচু ভূমিতে চলে আসে, ফলে মানুষ-সাপ সাক্ষাৎ বাড়তে পারে।
• নভেম্বর-ডিসেম্বর—শীত। তাপমাত্রা কমে গেলে চলাচল কম; লোকালয়ে দেখা প্রায় হয় না।
গ্রাম বনাম শহর: ঝুঁকির তফাৎ
চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ঘেরা গ্রামে কাঠ বা বাঁশ কাটতে গিয়ে হঠাৎ মুখোমুখি হওয়ার গল্প শোনা যায়, তবে নিশ্চিত কামড়ের সংখ্যা হাতে-গোনা। দেশের আরেক প্রান্তে, ঢাকার কংক্রিটের জঙ্গল এই সাপের কাছে প্রায় নিষিদ্ধ এলাকা; শুধু পাচারকৃত বা চিড়িয়াখানার পালানো ‘গেস্ট’ ছাড়া শহুরে ঝুঁকি নেই বললেই চলে। বন্দরনগরী চট্টগ্রামেও সাম্প্রতিক উদ্ধার ঘটনায় আতঙ্ক ছড়ালেও দংশনের সত্যতা মেলেনি।
প্রাথমিক চিকিৎসাই জীবনভর পার্থক্য
কামড়ের ঘটনায় পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনমই শেষ ভরসা। তাই বনের কাছে কাজ করা শ্রমিকদের নির্দেশ—বুট পরুন, দণ্ড হাতে চলুন, সাপ দেখলেই দূরত্ব বজায় রেখে বন বিভাগে খবর দিন। দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছাতে পারলে বাঁচার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
সংরক্ষণ সংকট
আইইউসিএন তালিকায় ‘Vulnerable’ ঠাঁই পাওয়া কিং কোবরা বন উজাড়, কৃষি সম্প্রসারণ ও আন্তর্জাতিক পাচারে কোণঠাসা। ২০১২-র বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে হত্যা বা পাচার দণ্ডনীয়, তবু পাহাড়ি চৌরাস্তায় গোপন ডিল চলে অবলীলায়। বিজ্ঞানীরা বলছেন—আবাসস্থলের করিডর মানচিত্রায়ন, পাহাড়ঘেরা স্কুলে সাপ-সচেতনতা ক্লাস আর ঘরোয়া অ্যান্টিভেনম উৎপাদন কেন্দ্র গড়া—এই তিন ধাপে রক্ষা পেতে পারে বন-সম্রাট।
জলা-পাহাড়ের দুয়ার রক্ষায় কিং কোবরা শুধু ভয়াবহ বিষের গল্প নয়, বরং একটি জীবন্ত সূচক—বন সুস্থ কি না, তা জানান দেয় তার টিকে থাকা। মানুষ-সাপ সংঘর্ষের অঙ্ক খুবই কম, কিন্তু কৌতূহল ও বৈজ্ঞানিক তথ্যের অভাবেই সাপটি অহেতুক আতঙ্কের মুখোমুখি। বনজ সংস্কৃতি, জীববৈচিত্র্য আর পাহাড়ি জনজীবন—সব রক্ষার কড়ি গুনতে হলে প্রথমেই বাঁচাতে হবে এই নীরব বন-সম্রাটকে।