০৫:৫৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

নিয়মের জালে ভারত: কেন আইন ভাঙাই নিত্যনৈমিত্তিক

এক গ্লাস বিয়ারেই আইনলঙ্ঘন

মুম্বাইয়ের গরম দিন শেষে যদি আপনি কিংফিশার বিয়ার হাতে স্বস্তি খুঁজে থাকেন, তাহলে জেনে রাখুন—১৯৪৯ সালের বোম্বে প্রোহিবিশন আইনের ৪০তম ধারা অনুযায়ী তা অপরাধ। অনুমতিপত্র ছাড়া মদ পান করলে প্রথমবার ধরা পড়লে জরিমানা ১০ হাজার রুপি ও ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।

অপরাধীর দেশে পরিণতি

দিল্লির আইনভাবনা প্রতিষ্ঠান ‘বিদি’র হিসাবে, জাতীয় পর্যায়ে ভারতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ ৭,৩০৫ টি; এর মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশের সাজা জেল। তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল অপরাধ ৫,১৯৯ টি (২০১৯-এর শেষ হিসাব)। চীনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান ৪৬ টি অপরাধে, আর ভারতীয় দণ্ডবিধিতে সংখ্যাটি ৩০১—তবে এর প্রয়োগ বিরল।

ব্যক্তিগত জীবনেও বিধিনিষেধ

উত্তরাখণ্ড রাজ্যে লিভ-ইন সম্পর্কের দম্পতিকে ৩০ দিনের মধ্যে নিবন্ধন করে ফি দিতে হয়; না করলে জরিমানা ও তিন মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড। সম্পর্ক ভাঙলেও ফের দপ্তরে গিয়ে ‘ডি-রেজিস্টার’ করতে হয়—সঙ্গী হারানোর সঙ্গে বাড়তি হয় কাগজপত্রের ঝামেলা।

করের কড়াকড়ি

ভাড়াটিয়ারা একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের বেশি ভাড়া দিলে তার অংশ ট্যাক্স কর্তন করে রাষ্ট্রের কাছে জমা দিতে বাধ্য—এর জন্য আবার পৃথক কর-নম্বর ও হিসাবরক্ষক নিয়োগ করতে হয়। কিছু আয়করদাতাকে বছরে চারবার কর পরিশোধ করতে হয়। জুনে সরকার ঘোষণা দিয়েছে, ভুল হিসাব বা মিথ্যা ছাড় দেখালে জরিমানা বাড়িয়ে মোট করের সর্বোচ্চ ২০০ শতাংশ নেওয়া হবে; উপরন্তু বার্ষিক ২৪ শতাংশ সুদ ও মামলা পর্যন্ত করা যাবে।

ব্যবসা বাড়লে বিড়ম্বনা আরও: পণ্য ও সেবা কর (GST)-এর নিবন্ধন বাধ্যতামূলক, তাও প্রত্যেক রাজ্যে আলাদাভাবে, যেখানেও শারীরিক উপস্থিতি না থাকলেও। ক্রেতার কাছ থেকে আদায় করা কর মাসে মাসে জমা দিতে হয়, টাকা হাতে না এলেও। বড় কোম্পানির আইনি বহর থাকলেও ছোট ব্যবসায়ীরা হিমশিম খান।

অদ্ভুত সব নিয়মের দঙ্গল

নতুন উড়ালপুল, কিন্তু গতিসীমা মাত্র ৩০ কিলোমিটার/ঘণ্টা। নিরাপত্তার অজুহাতে পার্কের ফটকে ইটের দেয়াল। বিমানবন্দরে মশলা মিশ্রণ জব্দ, অথচ একই নুডুলস প্যাকেটের ভিতরের মশলা রেহাই পায়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শক্তি সাশ্রয়ের নামে এসি-র তাপমাত্রা ২০–২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে বেঁধে দিলেন। কেরালায় রাস্তা পার হতে গিয়ে ফোনে ব্যস্ত থাকলে জরিমানার প্রস্তাব; গোয়ায় সমুদ্র-ঝুপড়িতে বাধ্যতামূলক ‘তাজা গোয়ান রান্না’—মন্ত্রী বলছেন, মাছ-ঝোল-ভাতই নাকি মানদণ্ড।

ঔপনিবেশিক ছাপনা রাষ্ট্রচিন্তার রোগ?

কলোনিয়াল যুগের আইনকে দোষারোপ করা সহজ। ২০২৩-এ ৪২ টি আইনের ১৮৩ টি অচল ধারা বাতিল হয়েছে; ব্যবসা-সহায়তায় দ্বিতীয় ধাপের সংস্কার ও ‘ডি-রেগুলেশন কমিশন’ গঠনের কাজ চলছে। কর-কোড সহজ করার বিলও প্রক্রিয়ায়। তবু ‘বিদি’র অরঘ্য সেনগুপ্তার কথায়, ‘আমরা মনে করি, ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি নিয়ন্ত্রণ করা রাষ্ট্রের কাজ—সবই আইন তৈরির উপাদান।’

আইন না মানার সংস্কৃতি

যখন প্রায় সবকিছুই নিষিদ্ধ, তখন নিয়ম মানতে কে আগ্রহী? ব্যবসা শুরু বা বাড়াতে গেলে অচিরেই নজরে পড়ে যায়, সঙ্গে আসে দপ্তরের কড়াল নিয়মাবলি। এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘রাষ্ট্র এমন মানদণ্ড দাঁড় করায় যা নাগরিকের পক্ষে মানা অসম্ভব; পরে আবার তাদেরই আইনভাঙা বলে দোষ দেয়।’ বাস্তবে রাষ্ট্রই মানুষকে আইনভঙ্গের পথে ঠেলে দিচ্ছে।

নিয়মের জালে ভারত: কেন আইন ভাঙাই নিত্যনৈমিত্তিক

১০:০০:২০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৬ জুলাই ২০২৫

এক গ্লাস বিয়ারেই আইনলঙ্ঘন

মুম্বাইয়ের গরম দিন শেষে যদি আপনি কিংফিশার বিয়ার হাতে স্বস্তি খুঁজে থাকেন, তাহলে জেনে রাখুন—১৯৪৯ সালের বোম্বে প্রোহিবিশন আইনের ৪০তম ধারা অনুযায়ী তা অপরাধ। অনুমতিপত্র ছাড়া মদ পান করলে প্রথমবার ধরা পড়লে জরিমানা ১০ হাজার রুপি ও ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।

অপরাধীর দেশে পরিণতি

দিল্লির আইনভাবনা প্রতিষ্ঠান ‘বিদি’র হিসাবে, জাতীয় পর্যায়ে ভারতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ ৭,৩০৫ টি; এর মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশের সাজা জেল। তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল অপরাধ ৫,১৯৯ টি (২০১৯-এর শেষ হিসাব)। চীনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান ৪৬ টি অপরাধে, আর ভারতীয় দণ্ডবিধিতে সংখ্যাটি ৩০১—তবে এর প্রয়োগ বিরল।

ব্যক্তিগত জীবনেও বিধিনিষেধ

উত্তরাখণ্ড রাজ্যে লিভ-ইন সম্পর্কের দম্পতিকে ৩০ দিনের মধ্যে নিবন্ধন করে ফি দিতে হয়; না করলে জরিমানা ও তিন মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড। সম্পর্ক ভাঙলেও ফের দপ্তরে গিয়ে ‘ডি-রেজিস্টার’ করতে হয়—সঙ্গী হারানোর সঙ্গে বাড়তি হয় কাগজপত্রের ঝামেলা।

করের কড়াকড়ি

ভাড়াটিয়ারা একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের বেশি ভাড়া দিলে তার অংশ ট্যাক্স কর্তন করে রাষ্ট্রের কাছে জমা দিতে বাধ্য—এর জন্য আবার পৃথক কর-নম্বর ও হিসাবরক্ষক নিয়োগ করতে হয়। কিছু আয়করদাতাকে বছরে চারবার কর পরিশোধ করতে হয়। জুনে সরকার ঘোষণা দিয়েছে, ভুল হিসাব বা মিথ্যা ছাড় দেখালে জরিমানা বাড়িয়ে মোট করের সর্বোচ্চ ২০০ শতাংশ নেওয়া হবে; উপরন্তু বার্ষিক ২৪ শতাংশ সুদ ও মামলা পর্যন্ত করা যাবে।

ব্যবসা বাড়লে বিড়ম্বনা আরও: পণ্য ও সেবা কর (GST)-এর নিবন্ধন বাধ্যতামূলক, তাও প্রত্যেক রাজ্যে আলাদাভাবে, যেখানেও শারীরিক উপস্থিতি না থাকলেও। ক্রেতার কাছ থেকে আদায় করা কর মাসে মাসে জমা দিতে হয়, টাকা হাতে না এলেও। বড় কোম্পানির আইনি বহর থাকলেও ছোট ব্যবসায়ীরা হিমশিম খান।

অদ্ভুত সব নিয়মের দঙ্গল

নতুন উড়ালপুল, কিন্তু গতিসীমা মাত্র ৩০ কিলোমিটার/ঘণ্টা। নিরাপত্তার অজুহাতে পার্কের ফটকে ইটের দেয়াল। বিমানবন্দরে মশলা মিশ্রণ জব্দ, অথচ একই নুডুলস প্যাকেটের ভিতরের মশলা রেহাই পায়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শক্তি সাশ্রয়ের নামে এসি-র তাপমাত্রা ২০–২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে বেঁধে দিলেন। কেরালায় রাস্তা পার হতে গিয়ে ফোনে ব্যস্ত থাকলে জরিমানার প্রস্তাব; গোয়ায় সমুদ্র-ঝুপড়িতে বাধ্যতামূলক ‘তাজা গোয়ান রান্না’—মন্ত্রী বলছেন, মাছ-ঝোল-ভাতই নাকি মানদণ্ড।

ঔপনিবেশিক ছাপনা রাষ্ট্রচিন্তার রোগ?

কলোনিয়াল যুগের আইনকে দোষারোপ করা সহজ। ২০২৩-এ ৪২ টি আইনের ১৮৩ টি অচল ধারা বাতিল হয়েছে; ব্যবসা-সহায়তায় দ্বিতীয় ধাপের সংস্কার ও ‘ডি-রেগুলেশন কমিশন’ গঠনের কাজ চলছে। কর-কোড সহজ করার বিলও প্রক্রিয়ায়। তবু ‘বিদি’র অরঘ্য সেনগুপ্তার কথায়, ‘আমরা মনে করি, ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি নিয়ন্ত্রণ করা রাষ্ট্রের কাজ—সবই আইন তৈরির উপাদান।’

আইন না মানার সংস্কৃতি

যখন প্রায় সবকিছুই নিষিদ্ধ, তখন নিয়ম মানতে কে আগ্রহী? ব্যবসা শুরু বা বাড়াতে গেলে অচিরেই নজরে পড়ে যায়, সঙ্গে আসে দপ্তরের কড়াল নিয়মাবলি। এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘রাষ্ট্র এমন মানদণ্ড দাঁড় করায় যা নাগরিকের পক্ষে মানা অসম্ভব; পরে আবার তাদেরই আইনভাঙা বলে দোষ দেয়।’ বাস্তবে রাষ্ট্রই মানুষকে আইনভঙ্গের পথে ঠেলে দিচ্ছে।