আগাম বর্ষার আগমনে বদলেছে ফসলের সময়সূচি
চলতি বছরের আগাম বর্ষা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চাষাবাদে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। আষাঢ় শুরুর আগেই প্রচুর বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ায় একদিকে যেমন কিছু অঞ্চলে সবজির উৎপাদন বেড়েছে, অন্যদিকে বিপাকে পড়েছেন আম, লিচুসহ মৌসুমি ফল ও অন্যান্য ফসল চাষিরা। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এর প্রভাব বেশি দেখা যাচ্ছে।
সবজি চাষে জলাবদ্ধতা, পচন ও ক্ষতির আশঙ্কা
রাজশাহী, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ, গাজীপুরসহ মধ্যাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের অনেক কৃষক জানাচ্ছেন, আগাম ও টানা বৃষ্টির ফলে খেতের জল নেমে যাওয়ার সুযোগ না থাকায় পচে যাচ্ছে শসা, বরবটি, লাউ, কুমড়োসহ অনেক সবজি।
নরসিংদীর এক সবজি চাষি মজনু মিয়া বলেন,
“পানির নিচে পড়ে আছে লাউগাছ। দুই সপ্তাহ আগেই ফুল ধরেছিল, এখন সব গাছ পচে গেছে।”
উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ে মাঠের ধনেপাতা, পালংশাক ও করোলার ক্ষেতেও দেখা দিয়েছে একই চিত্র। পানি না সরাতে পারলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে বলে জানিয়েছে কৃষি অফিস।
আম ও লিচু সংগ্রহে বাধা, মান কমছে
মৌসুমি ফলের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষিরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। সাধারণত জুনের মাঝামাঝি থেকে আম সংগ্রহ পুরোদমে চলে, কিন্তু এবার আগাম বৃষ্টির কারণে আম পরিপক্ব হওয়ার আগেই ঝরে পড়ছে।
রাজশাহীর বাগান মালিক মিঠুন আলী বলেন,
“গোপালভোগ এখনও পরিপক্ব হয়নি। কিন্তু বৃষ্টিতে আম নরম হয়ে গাছ থেকেই পড়ে যাচ্ছে।”
একই ধরনের সংকট দেখা যাচ্ছে দিনাজপুর ও নওগাঁর লিচু চাষে। অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে লিচুর গায়ে দাগ পড়ে যাচ্ছে, ফলে বাজারে চাহিদা কমে গেছে।
ধানের চারা রোপণে কিছু সুবিধা
তবে এই বর্ষায় কিছু সুফলও মিলছে। বর্ষার আগমনে বীজতলা তৈরি ও ধানের চারা রোপণে সুবিধা পাচ্ছেন দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকরা। পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার কৃষকরা জানাচ্ছেন,
“বছরের এই সময় পানির অভাবে চারা রোপণ করা যেত না, এবার আগেই মাঠ ভিজে গেছে। সময়মতো আমন চাষ শুরু করতে পারব।”
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও বলছেন, যদি পানি সরানোর ব্যবস্থা ঠিক থাকে, তাহলে অনেক কৃষকই ধান চাষে সময়ের সাশ্রয় করতে পারবেন।
বিশেষজ্ঞ মত: পূর্বপ্রস্তুতির অভাবে বিপাকে কৃষক
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি আবহাওয়াবিদ ড. রেজাউল করিম জানান,
“আবহাওয়ার অনিয়মিত আচরণ এখন কৃষির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কৃষকদের এমন সময়ের জন্য পূর্বপ্রস্তুতি, জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা ও ফল সংগ্রহ কৌশল শিখতে হবে। না হলে সামান্য বৃষ্টিই হয়ে উঠবে মহা দুর্যোগ।”
তিনি আরও বলেন, সরকার ও কৃষি বিভাগের সমন্বয়ে দ্রুতগতিতে কৃষকদের মাঝে পূর্বাভাস ও প্রশিক্ষণ পৌঁছাতে হবে।
সরকার বলছে নজর রাখা হচ্ছে
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (ফসল) মাহফুজুর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন,
“আগাম বর্ষার কারণে কিছু জায়গায় ক্ষতি হলেও আমরা জেলা কৃষি কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি দ্রুত চাষিদের পাশে দাঁড়াতে। বিশেষভাবে ফল ও সবজি চাষিদের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজও বিবেচনায় আছে।”
জলবায়ু পরিবর্তনে চাষে সময়ের নতুন হিসাব
এ বছর আগাম বর্ষার অভিজ্ঞতা আবারও প্রমাণ করল, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশি কৃষির সময়সূচি ও উৎপাদন ব্যবস্থায় বড় রকমের পরিবর্তন আনছে। ফল ও সবজি চাষিরা যেমন ক্ষতির মুখে, তেমনি কিছু ধানচাষি পেয়েছেন আগাম সুবিধা। তবে স্থায়ী সমাধানের জন্য দরকার মাঠপর্যায়ে সচেতনতা, পূর্বাভাস ভিত্তিক সিদ্ধান্ত এবং সরকারিভাবে সহায়তার দ্রুত বাস্তবায়ন।