চীন-রাশিয়া সাহিত্য সম্পর্ক: ইতিহাস থেকে বর্তমান
চীন ও রাশিয়ার মধ্যে সংস্কৃতি বিনিময় কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সম্প্রতি বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হলো “Reading through the Seasons” নামের চীন-রাশিয়া সাহিত্য সেলুন। এই অনুষ্ঠানের মূল বক্তা ছিলেন লিউ ওয়েনফেই — যিনি ক্যাপিটাল নর্মাল ইউনিভার্সিটির রুশ ভাষার অধ্যাপক এবং রাশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সেস-এর বিদেশি সদস্য। তাঁর জীবন জুড়ে অসংখ্য রুশ কবিতা ও উপন্যাস অনুবাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে। এই লেখাটি তাঁর সেলুনে প্রদত্ত বক্তৃতার ভিত্তিতে লিখিত।
প্রায় এক দশক আগে, লিউ “চীন-রাশিয়া সাহিত্য কূটনীতির সম্ভাবনা” শীর্ষক বক্তৃতা দেন। আজ সেই ধারণা আর কেবল সম্ভাবনা নয়, বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে।
সাংস্কৃতিক বন্ধনের কেন্দ্রবিন্দু: সাহিত্য
লিউর মতে, রাষ্ট্র পর্যায়ে চীন-রাশিয়ার সম্পর্ক যতই শক্তিশালী হোক না কেন, এই দুই জাতির মানুষে মানুষের এবং সংস্কৃতির বিনিময়ই হলো সম্পর্কের প্রকৃত ভিত্তি। আর এই বিনিময়ের কেন্দ্রস্থানে রয়েছে সাহিত্য। এর পেছনে রয়েছে উভয় দেশের দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির রূপান্তর।
চীন এবং রাশিয়া উভয় দেশই সাহিত্যিক ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। চীনের রাজবংশীয় ইতিহাসে সাহিত্যের গুরুত্ব ছিল সর্বোচ্চ। টাং যুগের কবিতা, সঙ যুগের গীতিকাব্য, ইউয়ান ও মিং যুগের নাটক এবং ছিং যুগের উপন্যাস — সব মিলিয়ে সাহিত্য চীনের প্রতিটি স্বর্ণযুগের পরিচায়ক।
রাশিয়ার ক্ষেত্রেও সাহিত্যের অবস্থান অনন্য। পুশকিন ও লারমন্টভের পর দস্তয়েভস্কি, তলস্তয় এবং চেখভের মতো লেখকের উদ্ভব রাশিয়াকে বিশ্বসাহিত্যের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত করে। সাহিত্যের মাধ্যমে রাশিয়া তার জাতীয় পরিচিতি গড়ে তোলে এবং দুই শতাব্দী ধরে বিশ্বে নিজেদের ‘সেরা পরিচয়পত্র’ হিসেবে সাহিত্যকে তুলে ধরে।
চীন-রাশিয়া সাহিত্য বিনিময়ের দীর্ঘ ঐতিহ্য
চীন-রাশিয়া সাহিত্যিক সম্পর্ক প্রায় ২৬৬ বছরের পুরোনো। ১৭৫৯ সালে ইউয়ান রাজবংশের নাটক “দ্য অরফান অব ঝাও” রুশ ভাষায় অনূদিত হয়। ১৭৭২ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে “চাইনিজ থটস” নামে চীনা সাহিত্যের প্রথম আলাদা সংকলন প্রকাশিত হয়। ১৯০৩ সালে পুশকিনের “দ্য ক্যাপ্টেনস ডটার” চীনা অনুবাদে প্রকাশিত হলে, সেটি হয়ে ওঠে চীনে প্রকাশিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ রুশ সাহিত্য অনুবাদ।
এরপর উভয় দেশ বিপুল পরিমাণে একে অপরের সাহিত্য অনুবাদ শুরু করে। রাশিয়ায় চীনের চারটি বিখ্যাত প্রাচীন উপন্যাস অনূদিত হয়েছে। কো ইউয়ান, লি বাই, দু ফু, পু সংলিং ও লু শুন-এর লেখাও রুশ পাঠকদের কাছে পরিচিত।
অন্যদিকে চীনেও রুশ ও সোভিয়েত সাহিত্যের হাজার হাজার রচনার অনুবাদ হয়েছে, যেগুলোর মুদ্রণসংখ্যা কয়েকশ কোটি ছাড়িয়েছে। এই সাহিত্যভিত্তিক সম্পর্ককে অনেক চীনা পাঠক “রুশ সাহিত্য প্রেমের বন্ধন” হিসেবে দেখেন।
আধুনিক যুগে রুশ ভাষায় চীনা সাহিত্য
গত এক দশকে রুশ সিনোলজিস্টরা আধুনিক চীনা সাহিত্য অনুবাদে অসাধারণ প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতা দেখিয়েছেন। ২০২৪ সালে পুরো রাশিয়ায় সর্বাধিক বিক্রীত বই ছিল একটি চীনা অনলাইন উপন্যাস – Heaven Official’s Blessing। যদিও এটি উচ্চ সাহিত্য নয়, কিন্তু জনপ্রিয়তার মাধ্যমে এটি রুশ সমাজে চীনা সাহিত্য গ্রহণযোগ্যতার এক মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।
মস্কো, সেন্ট পিটার্সবার্গসহ রাশিয়ার বিভিন্ন শহরের বইয়ের দোকানে মো ইয়ান, তিয়ে নিং ও ইউ হুয়া-র বই দেখা যায়। কিছু দোকানে তো “চীনা সাহিত্য” বা “আধুনিক চীনা সাহিত্য” নামে বিশেষ সেলফই আছে।
সাহিত্য কূটনীতির নতুন দিগন্ত
২০১৪ সালে লিউ ওয়েনফেই বেইজিং ও মস্কো থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা October-এর মধ্যে যৌথ প্রকাশনার প্রস্তাব দেন। এরপর “চীন-রাশিয়া অক্টোবর পত্রিকা সাহিত্য ফোরাম” প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৬ সালে ‘চীন-রাশিয়া মিডিয়া এক্সচেঞ্জ ইয়ার’-এ তিনি দু’দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০টি সাহিত্যকর্ম বাছাইয়ের কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন।
এইসব উদ্যোগ এবং আজকের অনুষ্ঠান প্রমাণ করে—চীন ও রাশিয়ার মধ্যে সাহিত্যিক বিনিময় এক গভীর ও জীবনন্ত বাস্তবতা। লিউ আশা প্রকাশ করেন, দুই দেশের সাহিত্য কূটনীতি আরও গভীর হবে এবং ফলপ্রসূ অর্জনের দিকেই এগিয়ে যাবে।
লেখক পরিচিতি:
লিউ ওয়েনফেই, ক্যাপিটাল নর্মাল ইউনিভার্সিটির মানবিক বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের পরিচালক এবং রাশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সেস-এর বিদেশি সদস্য।