নিরাপত্তারক্ষী আসাদুল্লাহর গল্প
করাচীর ক্লিফটন এলাকা থেকে ফজরের নামাজের পর ১০ কিলোমিটার হেঁটে সাদ্দার পৌঁছান আসাদুল্লাহ খান। দুপুরের প্রচণ্ড আর্দ্রতায় ঘামে ভেজা ইউনিফর্ম শুকোতে তিনি অফিসের পার্কিংয়ে পুরোনো ফ্যানের সামনে দাঁড়ান। মাসে মাত্র ২৫ হাজার রুপি মজুরিতে ১২ ঘণ্টা ডিউটি করে তাঁকে আবার দুই ঘণ্টা হেঁটে পরিবারসহ ভাগাভাগি করা এককক্ষের বাসায় ফিরতে হয়। অথচ সরকারি ন্যূনতম মজুরি ৩৭ হাজার রুপি—নিজের অধিকারের কথাই তিনি জানেন না।
ন্যূনতম মজুরির বাস্তবতা
২০২৪–২৫ অর্থবছরে পাকিস্তান সরকার অদক্ষ শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ৩৭ হাজার রুপি নির্ধারণ করলেও সিন্ধু প্রদেশের জন অ্যাকাউন্টস কমিটির তথ্যে ৮০ শতাংশ বেসরকারি কারখানা এ নির্দেশনা মানছে না। ন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের মহাসচিব নাসির মনসুরের মতে, ৯৫ শতাংশ কারখানাই ন্যূনতম মজুরি দেয় না।
‘মজুরি চুরি’—সিন্ধু সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট বোর্ডের উদাহরণ
এই বোর্ডে (এসএসডব্লিউএমবি) প্রায় ১২ হাজার পরিচ্ছন্নতাকর্মীর প্রত্যেকে মাসে ২০ হাজার রুপি পান, ফলে বছরে ২.৪ বিলিয়ন রুপি মজুরি কম দেন ঠিকাদারেরা। বোর্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দাবি করেন, ঠিকাদারদের মাধ্যমে ন্যূনতম মজুরিই দেওয়া হয়; তবে ভুক্তভোগীরা জানান—অবৈধভাবে দুই–তিন স্তরের সাবকন্ট্রাক্টে শ্রমিক নিয়োগ, কোনো লিখিত চুক্তি না থাকা এবং অভিযোগ করলেই চাকরিচ্যুতির ঘটনা নিয়মিত ঘটে।
ন্যূনতম মজুরি কি পর্যাপ্ত?
মানবাধিকার কমিশন (এইচআরসিপি) বলছে, ছয় সদস্যের পরিবার টিকিয়ে রাখতে মাসে অন্তত ৭৫ হাজার রুপি প্রয়োজন। পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ন্যূনতম মজুরি ৫০ হাজার রুপিতে উন্নীত করার দাবি তুললেও প্রকৃত সমস্যা হলো—ঘাটতি, বিলম্বিত বা কাটা মজুরি। কোরাঙ্গির একটি ডেনিম কারখানার অপারেটর হিনা আমিন জানান, ৩৭ হাজার রুপি বেতন পেলেও মাস শেষে ভাড়া ও খাবার মিটতেই ঋণ নিতে হয়; সময়মতো বেতন না পেলে প্রতিবাদ করলেই চাকরি যায়।
আইন, বাস্তবায়ন ও অভিযোগ প্রক্রিয়ার দুর্বলতা
১৮তম সংশোধনের পর শ্রম আইন প্রাদেশিক দায়িত্ব। সিন্ধু ন্যূনতম মজুরি আইন ২০১৫ অনুযায়ী মজুরি নির্ধারণ করা হলেও পরিদর্শক পদ খালি, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা দুর্বল। অভিযোগ করতে হলে শ্রমিককে লিখিতভাবে পেমেন্ট অব ওয়েজেস কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদনের ঝক্কি পোহাতে হয়; কোনো হেল্পলাইন বা সচেতনতা কর্মসূচি নেই। নিয়োগকর্তা না মানলে ছয় মাস কারাদণ্ড বা ২০–৫০ হাজার রুপি জরিমানার বিধান থাকলেও বাস্তবে দায়মুক্তিই দেখা যায়।
শিল্পের যুক্তি ও ব্যয়-চাপ
শ্রমঘন খাতে চাহিদা কমে গেলে মজুরি বাড়ানো ‘ব্যবসা টিকিয়ে রাখা’র চ্যালেঞ্জ—মত ফেডারেশন অব পাকিস্তান চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধিদের। তাঁদের মতে, ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের সামর্থ্য বিবেচনা না করলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়ে ভোক্তার ওপর চাপ পড়বে; তাই ধাপে ধাপে বাস্তবায়নই বাস্তবসম্মত।
ব্যবস্থাপনাগত ব্যর্থতা ও শ্রমিকের ভবিষ্যৎ
শ্রম অধিদপ্তর ও সেসসি (এসইএসএসআই)-এর সমন্বয়হীনতা, দুর্নীতি ও তথ্যের অভাব শ্রমিকদের সুরক্ষা খর্ব করছে। মানবাধিকার আইনজীবী জিবরান নাসিরের ভাষায়, ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর ঘোষণাকে কার্যকর ফলশ্রুতি না এনে ‘আড়ম্বরপূর্ণ’ করে রেখেছে দুর্বল প্রয়োগ ও প্রশাসনিক উদাসীনতা।
শ্রমিকের দিনশেষের হিসাব
প্রহরারত আসাদুল্লাহ কিংবা পরিচ্ছন্নতাকর্মী দাস—লাখো শ্রমিকের দুঃখ লাঘব হয় না আইন, নীতি ও শিল্পমালিকদের ‘দ্বন্দ্ব’ মীমাংসাতেও। ন্যূনতম মজুরি পেলেও বাড়তি ব্যয় ও সময়মতো বেতন না-পাওয়ার কারণে তাঁদের জীবনযাত্রা টিকে আছে নিছক সংগ্রামে; না-পাওয়া ন্যূনতম মজুরি আদায়ের লড়াই তো এখনও পথের দূরত্বেই রয়ে গেছে।