২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে ঢাকার অভিজাত গুলশান এলাকায় হোলি আর্টিজান বেকারিতে বর্বর জঙ্গি হামলা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ভয়াবহ দৃষ্টান্ত। ২২ জন নিরপরাধ মানুষ নিহত হন—তাদের মধ্যে বিদেশি নাগরিকও ছিলেন। হামলাকারীদের একজন ছিলেন রোহান ইমতিয়াজ। তিনি ঢাকার ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষার্থী, আধুনিক উচ্চ-মধ্যবিত্ত জীবনের প্রতীক। তার বাবা ছিলেন বাংলাদেশের শাসক দল আওয়ামী লীগের রাজনীতিক। এই পারিবারিক আর সামাজিক প্রেক্ষাপটের মধ্য থেকেও কীভাবে সে ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হয়ে উঠল?
রোহান ইমতিয়াজের পারিবারিক ও সামাজিক পটভূমি
রোহানের বাবা স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের এক নেতা ছিলেন। পরিবার ছিল আর্থিকভাবে স্বচ্ছল, সামাজিকভাবে প্রগতিশীল। রোহান পড়াশোনা করেছে ঢাকার অভিজাত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। তার প্রাথমিক জীবনে কোনো চরমপন্থার স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল না। এমন পরিবার থেকে আইএসের মতো উগ্র সহিংস জঙ্গি গোষ্ঠীর চরম আদর্শে তার আকৃষ্ট হওয়া বাংলাদেশের সমাজকে স্তম্ভিত করে।
কেন শিক্ষিত, আধুনিক পরিবার থেকে এমন উগ্রপন্থা?
বিশ্লেষকরা বলেন, আধুনিক ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষায়ও ধর্মীয় বা নৈতিক শিক্ষার শূন্যতা, পরিচিত সমাজের মূল্যবোধে বেদনার্ত বিভাজন, বৈশ্বিক অনলাইন প্রপাগান্ডার হাতছানি এবং আত্মপরিচয়ের সংকট—সবকিছু একসাথে কাজ করে। মধ্যবিত্ত বা উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা অনেক তরুণ যখন অর্থনৈতিক বা সামাজিক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও জীবনের গভীর অর্থ নিয়ে দ্বন্দ্বে পড়ে, তখন আইএসের মতো গোষ্ঠী তাদের ‘মিশন’ বা ‘উদ্দেশ্যের বোধ’ দিতে পারে।
আইএসের বৈশ্বিক কৌশল: ধনী ও শিক্ষিত তরুণদের টার্গেট
আইএস শুধু দরিদ্র বা সুবিধাবঞ্চিতদের নয়, বরং শিক্ষিত, প্রযুক্তি-সচেতন তরুণদেরও রিক্রুট করতে পেরেছে। এর জন্য তারা অত্যাধুনিক অনলাইন প্রচারণা, আকর্ষণীয় ভিডিও প্রোডাকশন, সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে। ‘হাইব্রিড জিহাদ’ বা ‘গ্লোবাল উম্মাহ’-র ধারণা দিয়ে তারা আধুনিক জীবনযাপনের মধ্যে থাকা হতাশা আর পরিচয় সংকটকে জ্বালানি বানায়।
আন্তর্জাতিক উদাহরণ: ব্রিটেনের জিহাদি কেস স্টাডি
ব্রিটেনে ২০১৫–১৬ সালে আইএসে যোগ দেওয়া বহু তরুণ-তরুণী ছিল অভিজাত স্কুলের ছাত্রছাত্রী। যেমন, লন্ডনের বেতুল কুবরা স্কুলের তিন কিশোরী—শামিমা বেগম, খাদিজা সুলতানা, আমিরা আবাসে—প্রথমে ইসলামি কন্টেন্ট দেখতে শুরু করে ইউটিউবে, পরে টুইটার ও ফেসবুকে আইএস রিক্রুটারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারা মধ্যবিত্ত, অভিবাসী পরিবার থেকে আসলেও পশ্চিমা সমাজে বর্ণবাদ, পরিচয় সংকট, মুসলিম পরিচিতি নিয়ে লজ্জা—এসবের মধ্যে নিজেদের আলাদা অবস্থান খুঁজছিল। আইএস এই শূন্যতা কাজে লাগায়।
আমেরিকার শিক্ষিত তরুণদের কেস স্টাডি
যুক্তরাষ্ট্রেও মিনেসোটা বা নিউ ইয়র্কে সোমালি অভিবাসী পরিবারের ছেলেরা, যারা স্থানীয় স্কুল বা কলেজে পড়ত, অনলাইন চরমপন্থার ফাঁদে পড়ে সিরিয়া চলে যায়। এদের বেশিরভাগ পরিবার ধর্মভীরু হলেও সহিংস উগ্রপন্থার ধারেকাছেও ছিল না। কিন্তু আইএসের ন্যারেটিভে ‘অপমানিত মুসলিম ভাইদের রক্ষা’, ‘শহীদ হওয়া’র মাধ্যমে জীবনের অর্থ পাওয়া—এ ধরনের গল্প তাদের টানে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রোহান ইমতিয়াজের র্যাডিকালাইজেশন
বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত, ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিত ছেলেদের মধ্যে একটি অংশে পশ্চিমা ধাঁচের জীবনের সঙ্গে ধর্মীয় পরিচয়ের দ্বন্দ্ব থাকে। রোহানের মতো শিক্ষার্থীরা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে, ইংরেজি সাহিত্য-সংস্কৃতি রপ্ত করে, কিন্তু ধর্মীয় বোধে পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা বা সমন্বয় পায় না। এই ফাঁককে আইএসের মতো গোষ্ঠী প্রচারণায় কাজে লাগায়।
সোশ্যাল মিডিয়ায়, প্রাইভেট গ্রুপে, এনক্রিপ্টেড চ্যাটে তাদের কাছে ‘গৌরবময় মুসলিম অতীত’, ‘অপমানিত উম্মাহ’, ‘পবিত্র যুদ্ধ’—এসব মিথ তৈরি করা হয়। আধুনিক জীবনকে ‘অপবিত্র’ ও ‘অর্থহীন’ হিসেবে উপস্থাপন করে, যা ছেড়ে সত্যিকারের ইসলামি শাসনের জন্য জীবন উৎসর্গ করা নায়কোচিত কাজ হিসেবে সাজানো হয়।
রাজনৈতিক পরিবেশের প্রভাব
রোহানের বাবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা, পরিবারে আধুনিক মূল্যবোধ, ক্ষমতাধর দলের সুবিধা—এসবকেই উল্টো করে ব্যবহার করা হয়। তাকে বোঝানো হয়, ‘তুমি গ্লোবাল উম্মাহর একজন, তোমার পরিবার বা দল ধর্মদ্রোহী, পশ্চিমা প্রভাবিত, মুসলিমদের শত্রুদের সহচর’। এতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়।
উপসংহার: প্রতিরোধের করণীয়
হোলি আর্টিজান ট্র্যাজেডি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে—শুধু দরিদ্র বা মাদ্রাসা নয়, আধুনিক শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছাত্রও ভয়ঙ্কর আইএস-স্টাইল জঙ্গি হতে পারে। এর প্রতিরোধে দরকার—
- সমাজে সমন্বিত পরিচয়বোধ তৈরি: তরুণদের জন্য ধর্মীয়, জাতীয়, বৈশ্বিক পরিচয় নিয়ে স্বাস্থ্যকর আলোচনা
- সমালোচনামূলক চিন্তা শিক্ষা: স্কুল-কলেজে রেডিকাল কন্টেন্টের সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ শেখানো
- অভিভাবক-শিক্ষকের নজরদারি: অনলাইন কর্মকাণ্ডে অস্বাভাবিক পরিবর্তন খেয়াল রাখা
- ডি-র্যাডিকালাইজেশন প্রোগ্রাম: সন্দেহভাজন বা প্রভাবিতদের পুনর্বাসনের জন্য পেশাদার সহায়তা
হোলি আর্টিজান হামলার শিক্ষা এই যে সন্ত্রাসবাদকে রুখতে হলে শুধু নিরাপত্তা নয়, সমাজের গভীরে থাকা মানসিক, সাংস্কৃতিক বিভাজন আর চিন্তাজগতের শূন্যতাকেও সমাধান করতে হবে।