ডেঙ্গুর সর্বশেষ অবস্থা সারা দেশে
বাংলাদেশে চলতি বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক রূপ নিয়েছে। সরকারি স্বাস্থ্য দপ্তরের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, জুলাই মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সারাদেশে সরকারি হিসেবে ৩০ হাজারের বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং মৃতের সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে গেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়েও বেশি হতে পারে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী—প্রায় সব বিভাগেই ডেঙ্গুর প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে। রাজধানী ঢাকায় পরিস্থিতি সবচেয়ে বিপজ্জনক, কারণ এখানে জনঘনত্ব বেশি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ড্রেনেজ ব্যবস্থার সমস্যা এবং জমে থাকা পানিতে এডিস মশার বংশবিস্তার রোধে কার্যকর পদক্ষেপের অভাব রয়ে গেছে।
মশকনিধন কার্যক্রমে দুর্বলতা
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন একাধিকবার মশা নিধনে ফগিং ও ওষুধ ছিটানোর কর্মসূচি চালিয়েছে। তবে বাসিন্দারা বলছেন, ওষুধের মান নিয়ে সন্দেহ আছে এবং ফগিং কার্যকর হচ্ছে না। অনেক স্থানে জমে থাকা পানির উৎস সরানো হচ্ছে না, যেখান থেকে এডিস মশা জন্ম নিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশা মারার কাজ নয়, বরং বংশবিস্তার নিয়ন্ত্রণই হচ্ছে মূল কৌশল। অথচ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো সে দিকেই নজর দিতে পারছে না।
প্রশাসনিক ব্যস্ততা ও রাজনৈতিক অগ্রাধিকার
সরকারি মহলে অনেকেই স্বীকার করছেন, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে স্বাস্থ্যঝুঁকির এই সংকট কাঙ্ক্ষিত গুরুত্ব পাচ্ছে না। ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিক্ষোভ, আন্দোলন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনা—এসব সামলাতেই প্রশাসনের অনেক অংশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তদুপরি, খাদ্যদ্রব্যের দাম, গ্যাস-বিদ্যুতের ঘাটতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমস্যা ও আইএমএফ শর্ত নিয়ে অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে সরকারের শীর্ষ মহল ব্যস্ত। ফলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং সিটি করপোরেশনগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা আরও প্রকট হচ্ছে।
জেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা এবং অপ্রস্তুতি
ঢাকার বাইরেও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, অথচ জেলা হাসপাতালগুলো ডেঙ্গু পরীক্ষার কিট, পর্যাপ্ত শয্যা, প্লেটলেট সাপোর্টের ব্যবস্থা করতে হিমশিম খাচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, কিট বিতরণ করা হচ্ছে, তবে মাঠ পর্যায়ে তদারকি কম। অনেক উপজেলা হাসপাতালে রক্ত পরীক্ষা বা IV সাপোর্টের সুবিধা নেই। ফলে রোগীরা জেলাশহর বা ঢাকায় এসে উপচে পড়ছে, যা হাসপাতাল ব্যবস্থাপনাকে আরও চাপে ফেলছে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও উপেক্ষা
বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করেছেন যে, বর্ষা শুরুর আগে থেকে মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত কর্মসূচি দরকার। বাড়ি-বাড়ি সচেতনতা, লার্ভা ধ্বংস, পানি জমার স্থান পরিষ্কার, নিয়মিত ফগিং ও ওষুধ ছিটানো—সব একসাথে দরকার। কিন্তু স্থানীয় সরকারের বাজেট, পরিকল্পনা ও সমন্বয় তেমন হয়নি। বরং সমস্যা বাড়ার পর ‘দায় এড়ানো’ নীতি দেখা যাচ্ছে—কেউ মন্ত্রণালয়ের দায়, কেউ সিটি করপোরেশনের দায় বলে দিচ্ছে।
ভবিষ্যতের ঝুঁকি ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে এডিস মশার বংশবিস্তার বছরজুড়েই হতে পারে, ফলে ডেঙ্গু শুধু মৌসুমি নয়, প্রায় স্থায়ী স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রূপ নেবে। এখনই পরিকল্পিত, বিজ্ঞানভিত্তিক, দীর্ঘমেয়াদি মশক নিয়ন্ত্রণ নীতি দরকার। নইলে প্রতি বছর এ ধরনের প্রাণঘাতী পরিস্থিতি ঘটবে। সরকারকে রাজনৈতিক চাপের মধ্যেও এই স্বাস্থ্যঝুঁকিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
সীমাবদ্ধতা ও সমন্বয়হীনতা
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ বারবার একই ভুল করছে—প্রতিক্রিয়াশীল পদক্ষেপ, বর্ষার পরে তড়িঘড়ি অভিযান, বাজেট সীমাবদ্ধতা, সমন্বয়হীনতা এবং রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের অভাব। স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশনকে উন্নয়নের কেন্দ্রে না রাখলে এ সঙ্কট থেকে মুক্তি সম্ভব নয়। ডেঙ্গু এখন আর শুধু রোগ নয়, এটি আমাদের নগরায়ণ, প্রশাসনিক কাঠামো এবং রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের এক আয়না—যা সবার সামনে দেশের বাস্তবতা স্পষ্ট করে তুলছে।