বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ ইতিহাসে মিঠা পানির কুমির একসময় পরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী ছিল। তবে আজ এই প্রজাতি দেশে বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। কুমিরের সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে, তাদের প্রাকৃতিক আবাস ধ্বংস হচ্ছে এবং জনসচেতনতা ও সুরক্ষার অভাবে টিকে থাকার লড়াই ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে মূলত মিঠা পানির কুমির হিসেবে পরিচিত মুগর কুমির (Mugger Crocodile) বা মার্শ কুমির (Crocodylus palustris) পূর্বে দেশের অনেক নদী, হাওর-বিল ও জলাশয়ে দেখা যেত। ব্রিটিশ শাসনামলের রেকর্ডেও এমন কুমিরের উল্লেখ আছে। ১৯ শতক ও ২০ শতকের শুরুর দিকে এই প্রজাতির বিস্তৃতি ছিল সুন্দরবনের উত্তরাংশ, পদ্মা-যমুনা-মেঘনা অববাহিকা, সিলেটের হাওরাঞ্চল পর্যন্ত।
তবে শিকার, নদীর চর পরিবর্তন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, জমির ব্যবহার পরিবর্তন এবং জলাশয়ের দূষণসহ নানা কারণে তাদের আবাস হারিয়ে যায়। ফলে আজ প্রকৃতিতে এদের সংখ্যা হাতে গোনা।
বর্তমান পরিস্থিতি
বর্তমানে বাংলাদেশের বন্য প্রকৃতিতে মিঠা পানির কুমিরের অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (IUCN) এই প্রজাতিকে “ভালনারেবল” বা “ঝুঁকিপূর্ণ” হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। বাংলাদেশে এই প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, যদিও কিছু অপ্রমাণিত দর্শন বা স্থানীয় জনশ্রুতি শোনা যায়।
এদিকে, চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, এবং ঢাকা চিড়িয়াখানায় সীমিত সংখ্যায় মিঠা পানির কুমির রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। এই বন্দি অবস্থায় সংরক্ষণপ্রচেষ্টা চলছে, তবে পুনঃপ্রাকৃতিকায়ন (reintroduction) কার্যক্রম নেই বললেই চলে।
প্রজনন ও জীববৈজ্ঞানিক বৈশিষ্ট্য
মিঠা পানির মুগর কুমির সাধারণত নদী-নালার পাড়ে বাস করে এবং ডিম পাড়ে বালির ঢিবিতে। স্ত্রী কুমির বছরে ২০–৩০টি ডিম পাড়ে, যা প্রায় ৬০–৭০ দিনে ফুটে বাচ্চা বের হয়। এরা মূলত মাছ, ছোট স্তন্যপায়ী, পাখি, সরীসৃপ ইত্যাদি খায়। মানুষের ওপর আক্রমণ খুবই বিরল।
কুমির প্রাকৃতিক পরিবেশে শিকারি শৃঙ্খলের শীর্ষে থাকায় বাস্তুসংস্থানকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরা মাছের রোগাক্রান্ত বা দুর্বল প্রজাতি খেয়ে জলের বাস্তুতন্ত্রকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
সংরক্ষণ চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে মিঠা পানির কুমির সংরক্ষণে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এর প্রাকৃতিক আবাস হারানো। নদীর প্রবাহ বদল, পাড় ভাঙন রোধে কংক্রিটের বাঁধ, নদীখনন, চর দখল, কৃষিজমি সম্প্রসারণ ও দূষণ—সবই কুমিরের আবাসস্থল ধ্বংস করেছে। শিকারও একসময় বড় সমস্যা ছিল।
অন্যদিকে জলাভূমি রক্ষা ও ব্যবস্থাপনা নীতি প্রায় নেই বললেই চলে। সংরক্ষণ সংক্রান্ত জনসচেতনতা নেই, স্থানীয় পর্যায়ে কুমিরকে বিপদ হিসেবে দেখা হয়। ফলে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে পুনর্বাসন বা বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি।
বর্তমান সংরক্ষণ উদ্যোগ
বাংলাদেশ বন বিভাগ ও বিভিন্ন চিড়িয়াখানা/সাফারি পার্কে কয়েকটি মিঠা পানির কুমির রাখা আছে। এদের প্রজনন করে সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়, তবে এখনো পর্যন্ত প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা হয়নি। সুন্দরবনে চাষা কুমির বা নোনা পানির কুমিরের (Saltwater Crocodile) জন্য কিছু সংরক্ষণ উদ্যোগ রয়েছে, তবে মিঠা পানির কুমিরের জন্য তেমন কোনো বৃহৎ প্রকল্প নেই।
ভবিষ্যৎ করণীয়
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের নদী-জলাভূমির সুরক্ষা, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ছাড়া মিঠা পানির কুমির সংরক্ষণ সম্ভব নয়। এদের প্রজনন সাফল্যকে কাজে লাগিয়ে পুনঃপ্রাকৃতিকায়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া প্রয়োজন।
উদাহরণ হিসেবে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের সফল মুগর কুমির সংরক্ষণ ও পুনর্বাসন কর্মসূচি থেকে শিক্ষা নেওয়া যায়।
মিঠা পানির কুমির বাংলাদেশের নদীজীবনের ইতিহাসে এক অনন্য প্রাণী। একে রক্ষা করা শুধু একটি প্রজাতিকে রক্ষা করা নয়, বরং আমাদের নদী ও জলাভূমির জীববৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক শৃঙ্খল রক্ষা করা। তাই মিঠা পানির কুমির সংরক্ষণে সময়োপযোগী, বৈজ্ঞানিক এবং টেকসই পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি।