টেস্ট ক্রিকেটে ধীরগতির ওভার-রেট নতুন কোনো সমস্যা নয়, তবে সাম্প্রতিক ইংল্যান্ড-ভারত সিরিজে বিষয়টি আবারও তীব্র আলোচনায় এসেছে। ম্যাচে দিনের পর দিন কম ওভার হওয়া, পয়েন্ট কাটা ও আর্থিক জরিমানা—এসব নিয়েও সমাধান আসছে না। কেন এমন হচ্ছে, নিয়ম কী বলে, আর কী করা যায়—তা নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা।
অস্বস্তিকর বাস্তবতা: দিনের পর দিন কম ওভার
লর্ডসে তৃতীয় টেস্টের দ্বিতীয় দিনে মাত্র ৭২.৩ ওভার বল হয়—যা নিয়মিত ৯০ ওভার থেকে ১৫ ওভার কম। এর মধ্যে কোনো বৃষ্টি বা আলো সমস্যা ছিল না, পুরোটা ধীরগতির খেলায় নষ্ট। পরের দুই দিনেও আরও ১৯ ওভার হারিয়ে যায়।
ভারতীয় শিবির বিরক্ত হয় যখন ইংল্যান্ডের জ্যাক ক্রলি ধীরগতির ট্যাকটিক্স নেন এবং একটি ওভার শেষ হতে প্রায় সাত মিনিট লাগে।
এর ফলস্বরূপ, ইংল্যান্ড দলকে ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে দুই পয়েন্ট কাটা হয়েছে এবং ম্যাচ ফি ১০ শতাংশ জরিমানা করা হয়েছে।
যদিও কিছু পরিস্থিতিকে ‘লাঘবকারী‘ বলা হয়েছে—যেমন ভারত অধিনায়ক শুভমান গিলের ফিল্ডের মধ্যে আট মিনিটের ম্যাসাজ বা রবীন্দ্র জাদেজার টয়লেট বিরতি—তবু গড়পড়তা ধীর গতি ক্রিকেটের জন্য ভালো বার্তা নয়।
নিয়ম-কানুন কী বলে?
পাঁচ দিনের টেস্টে প্রতিদিন ৯০ ওভার বল করার নিয়ম আছে। শেষ দিনে সব ওভার করতে হয় (যদি আবহাওয়া বিঘ্ন না ঘটায়), যাতে কোনো দল কৌশলগতভাবে সময় নষ্ট করে ড্র করতে না পারে।
প্রথম চার দিনে ওভারগুলো ছয় ঘণ্টার মধ্যে শেষ করতে হয়, প্রয়োজনে অতিরিক্ত আধ ঘণ্টা পাওয়া যায়। আবহাওয়ায় নষ্ট হওয়া সময় পরের দিন পূরণ করা যায়, কিন্তু ধীর গতির কারণে হারানো ওভার আর ফেরে না।
আইসিসির নিয়মে কিছু শাস্তি আছে, যেমন সময় নষ্ট করলে পাঁচ রান পেনাল্টি দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু টেস্টে কখনও প্রয়োগ হয়নি।
সম্প্রতি ৬০ সেকেন্ডের ‘স্টপ ক্লক‘ চালু হয়েছে ওভার-বিরতিতে, কিন্তু প্রথম দুই টেস্টে সতর্কবার্তা দেওয়া হলেও কোনো অধিনায়ককে শাস্তি দেওয়া হয়নি।
সবচেয়ে প্রচলিত শাস্তি হলো ফাইন এবং ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পয়েন্ট কাটা।
২০২৩-২৫ চক্রে ইংল্যান্ড ২২ পয়েন্ট হারিয়েছে। অধিনায়ক বেন স্টোকস বলছেন, ইংল্যান্ডে স্পিনার কম হওয়ায় ফাস্ট বোলারদের দীর্ঘ রান-আপে সময় বেশি লাগে।
ইতিহাসে ওভার-রেটের পরিবর্তন
ওভার-রেট কমা নতুন কিছু নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে গড় ছিল ঘণ্টায় ২১ ওভার। ১৯৪৫-৭৪ সালে তা ১৮-তে নেমে আসে। ১৯৭৫-৯৯ সময়ে গড় ছিল ১৪.৩, আর ২০০০ সালের পর প্রায় ১৪।
ইংল্যান্ড-ভারত সিরিজে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। প্রথম দুই টেস্টে গড় ছিল ১৩.৩ ওভার প্রতি ঘণ্টায়। প্রথম টেস্টে ৩৯ ওভার এবং দ্বিতীয় টেস্টে ১৯ ওভার হারিয়েছিল।
এক বড় কারণ হলো বল পরিবর্তন। বল নরম বা আকার হারালে দুই দলই বারবার বল বদলাতে চেয়েছে, এতে সময় নষ্ট হয়েছে।
লর্ডসে দ্বিতীয় দিনের প্রথম ড্রিঙ্কস ব্রেকই ছয় মিনিটের বেশি লেগেছে। অতিরিক্ত গরমে খেলে অনিয়মিতভাবে ড্রিঙ্কস ব্রেক হয়েছে, গ্লাভস বদলানো হয়েছে, ছোটখাটো ইনজুরি চিকিৎসাও হয়েছে।
খেলোয়াড়দের প্রতিক্রিয়া
ইংল্যান্ডের জো রুট বলছেন, প্রতিটি ইনিংসে তিনবারের বেশি বল পরিবর্তন না করতে দিলে সময় বাঁচানো যায়। তিনি বলেন, ইংল্যান্ডের ৩০ ডিগ্রির গরম অন্য দেশের ৪৫ ডিগ্রির সমান অনুভব হয়, তাই এমন দিনগুলোয় দ্রুত গতিতে খেলা কঠিন।
ভারতের জসপ্রিত বুমরাহ বলেন, “খুব গরম। বোলারদের জন্য কঠিন। কখনো সময় নিতে হয় যেন কোয়ালিটি খারাপ না হয়।”
বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি
সাবেক ইংল্যান্ড অধিনায়ক মাইকেল ভন বলেন, “পঞ্চম দিনে ৯০ ওভার করতেই হয়। তাহলে প্রথম চার দিনে কেন শামুক গতিতে খেলা হবে? সব দিনেই ৯০ ওভার করতে বাধ্য করতে হবে।”
বিবিসির প্রধান ক্রিকেট ভাষ্যকার জোনাথন অ্যাগনিউ বলেন, “এভাবে ১৫ ওভার কম হওয়া মানা যায় না। ফাইন কাজ করছে না। ড্রিঙ্কস ব্রেকের সময় স্টপ ক্লক চালু করে শাস্তি দিতে হবে। একমাত্র কারেন্সি খেলোয়াড়রা বোঝে, তা হলো রান পেনাল্টি।”
টেস্ট ম্যাচ স্পেশালের পরিসংখ্যানবিদ অ্যান্ডি জাল্টজম্যান বলেন, “খেলার মান ভালো, তবে প্রতিদিন আরও ওভার হলে আরও ভালো হবে। ওভার-বিরতিতে এখন ক্লক আছে, কিন্তু খেলোয়াড়রা মানে না। ইন-গেম শাস্তি দরকার—রান পেনাল্টি বা কার্ড সিস্টেম।”
সাবেক অধিনায়ক অ্যালাস্টার কুক বলেন, “সমস্যা বহুদিনের। খেলোয়াড়দের নয়, আইসিসি ও আম্পায়ারদের দায়িত্ব গতি ঠিক রাখা। ড্রিঙ্কস ব্রেক ছোট করা দরকার।”
ক্রিকেট বিশ্লেষক সাইমন ম্যান বলেন, “রান পেনাল্টি একটু কৃত্রিম মনে হয়। বরং পরের ইনিংসে ওই দলকে একজন ফিল্ডার কম নিয়ে বোলিং করাতে হবে।”
সাবেক ইংল্যান্ড পেসার স্টিভেন ফিন বলেন, “রান পেনাল্টি টাকা জরিমানার চেয়ে ভালো, তবে সবসময় বোলিং টিম দোষী নয়। ছোট ইনজুরি, গ্লাভস বদল এসবও সময় নেয়।”
বিবিসির উপস্থাপক ইসা গুহা বলেন, “দর্শকরা টাকা দিয়ে আসে অ্যাকশন দেখতে। খেলার সময় বাড়ানো যায়। পরের দিন আধ ঘণ্টা আগে শুরু করে আগের দিনের ওভার পূরণ করা সম্ভব।”
টেস্ট ক্রিকেটের সৌন্দর্য এর ধীরতা ও কৌশলে, তবে শৃঙ্খলাহীন ধীরগতি দর্শক-আকর্ষণ নষ্ট করে। আইসিসি, আম্পায়ার ও খেলোয়াড়দের সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না।