বিশ্ব আজ এমন এক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে যেখানে শক্তি খাতের ভবিষ্যৎ রূপায়ণ হবে দুই মহাশক্তি—চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে।
চীনের নবায়নযোগ্য শক্তির অগ্রযাত্রা
গত বছর বিশ্বব্যাপী উইন্ড টারবাইন ও সৌরশক্তি প্যানেল স্থাপনের ক্ষেত্রে চীন অন্য সব দেশের সমষ্টিকেও ছাড়িয়ে গেছে। দেশটি নিজ দেশে যেমন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, তেমনই বিদেশেও সৌর ও বায়ু প্রকল্প গড়ে তুলছে। ব্রাজিল, থাইল্যান্ড, মরক্কো, হাঙ্গেরি সহ বহু দেশে বৈদ্যুতিক যান ও ব্যাটারি কারখানা নির্মাণ করে চীন বিশ্ব বাজারে আধিপত্য বিস্তার করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জীবাশ্ম জ্বালানিতে দ্বিগুণ মনোযোগ
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসন জীবাশ্ম জ্বালানির উপর গুরুত্ব দিয়ে নীতি গ্রহণ করেছে। স্থানীয় উৎপাদন বাড়াতে পাবলিক জমিতে তেলের খনন দ্রুত অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে, পাইপলাইন নির্মাণের অনুমতি ত্বরান্বিত হচ্ছে এবং অন্যান্য দেশগুলোকে আমেরিকান গ্যাস ও তেল কিনতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। জেনারেল মোটরস একটি প্রকল্প বাতিল করে ৮৮৮ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের মাধ্যমে আবার V-8 পেট্রোল ইঞ্জিন তৈরি শুরু করেছে।
শক্তি নিরাপত্তা বনাম জলবায়ু উদ্বেগ
দুই দেশের এ কৌশলই মূলত অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থে গড়ে উঠেছে—জলবায়ু পরিবর্তনকে কম প্রাধান্য দিয়ে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন অব্যাহত থাকলে মারাত্মক খরা, ঝড়বৃদ্ধি, আবহাওয়ার প্যাটার্নে পরিবর্তন, খাদ্য উৎপাদনে বিঘ্ন এবং সমুদ্রস্তরের বৃদ্ধির কারণে বড় শহর ডুবে যাওয়ার মতো ঝুঁকি বেড়েই যাবে।
বৈশ্বিক শক্তির ভবিষ্যৎ
এই প্রতিযোগিতা শুধুমাত্র দুই দেশের মধ্যে লড়াই নয়; এটি পুরো পৃথিবীর শক্তি ব্যবহারের রূপরেখা নির্ধারণের লড়াই। যেখানে একদিকে চীন সাশ্রয়ী সৌর প্যানেল, বায়ু টারবাইন ও দ্রুত চার্জিং প্রযুক্তি উন্নয়ন করে ভবিষ্যতের শক্তি ব্যবস্থার ভিত্তি গড়ছে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র জীবাশ্ম জ্বালানির বাজার ধরে রাখায় জোর দিচ্ছে।
চীনের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা
২০০৩ সালে আবহাওয়া দূষণ ও শক্তি নিরাপত্তা মাথায় রেখে চীনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও নবায়নযোগ্য শক্তিকে জাতীয় কৌশলের অংশ করেছেন। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারি অনুদান ও ভর্তুকি দেওয়া হয় এবং বিদেশি প্রতিযোগীদের বাজারে প্রবেশ সীমিত রাখা হয়। এর ফলে আজ চীন সৌর প্যানেল, উইন্ড টারবাইন, ইলেকট্রিক গাড়ি ও ব্যাটারি উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বনেতা হয়েছে।
আমেরিকার ইতিহাস ও প্রত্যাবর্তন
যুক্তরাষ্ট্র এক সময় নবায়নযোগ্য শক্তিতে নেতৃত্ব দিয়েছিল—১৯৫০-এর দশকে প্রথম সিলিকন ফোটোভোলটাইক কোষ উদ্ভাবন, ১৯৭০-এর দশকে লিথিয়াম-অয়ন ব্যাটারি তৈরি, নিউ হ্যাম্পশায়ারে প্রথম বায়ু খামার গড়ে তোলা। তবে জীবাশ্ম জ্বালানির সহজলভ্যতা ও শিল্পব্যবস্থার চাপের কারণে নবায়নযোগ্য শক্তি বৃদ্ধিকে সেই সময় প্রাধান্য মিলেনি।
প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয় বনাম অস্থায়ী নীতি
চীনে সরকারি নীতি নির্ধারক, বেসরকারি সেক্টর ও প্রকৌশলীরা যৌথভাবে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য নিয়ে কাজ করেন। আমেরিকায় এ ধরনের সমন্বয় অল্প সময়ের জন্যই টিকে থাকে, পরে নীতিমালার অগ্রাধিকার বদলায়। এর ফলে চীনের শত শত বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আজ ফল দিয়েছে এবং তারা বাজারে আক্রামক দরে সরঞ্জাম বিক্রয়ে সক্ষম হয়েছে।
দ্বিপক্ষীয় প্রতিক্রিয়া
যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল-গ্যাস উৎপাদক ও রপ্তানিকারক হিসেবে, জীবাশ্ম জ্বালানিতে “এনার্জি ডমিনেন্স” ধরে রাখতে চায়। তারা বিদেশি নির্ভরতা কমিয়ে বৈদেশিক আয় বাড়ানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। একই সময়ে চীন সস্তা ও টেকসই শক্তি সরঞ্জামের ওপর বিশ্বকে নির্ভর করতে উৎসাহিত করছে।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি
মধ্যপ্রাচ্যে—বিশেষ করে ইরান-ইস্রায়েল সংঘর্ষ—যেমন ঘটনাগুলো দেখিয়েছে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা শক্তি আমদানিতে বিপদ আনতে পারে। এজন্য চীন বিদেশি তেলের ওপর নির্ভরতা কমাতে নবায়নযোগ্য শক্তি বৃদ্ধিতে জোর দিচ্ছে।
মার্কেট ও ভূ-রাজনীতি
শক্তি সরবরাহকে অনিবার্য সেবা হিসেবে গণ্য করে প্রশাসন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক
এই প্রতিযোগিতায় অবিলম্বে কোন পক্ষ “জয়ী” হবে তা বলা মুশকিল, কারণ এখনো মোট শক্তি চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ মেটছে জীবাশ্ম জ্বালানিতে। তবে আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা অনুমান করেছে, মধ্য শতাব্দির মধ্যে এ শতাংশ ৬০-এর নিচে নেমে যাবে, আর সে সময় চীন বৈশ্বিক শক্তি সরবরাহে প্রাধান্য গড়ে তুলবে। মানবকল্যাণ এবং পরিবেশ রক্ষা নিশ্চিত করতে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও জলবায়ু ঝুঁকির মধ্যে সঠিক ভারসাম্য করতে হবে।