শৈশব ও শুরুটা
বাংলা চলচ্চিত্রের আলোচিত ও বহুল আলোচিত নাম পরীমণি। জন্ম ১৯৯২ সালের ২৪ অক্টোবর, সাতক্ষীরা জেলায়। শৈশবে বাবা-মাকে হারিয়ে নানা-নানির কাছে বড় হন। এই প্রতিকূলতাই তাকে জীবনের প্রতি সংবেদনশীল করে তোলে, যা তার অভিনয়ের গভীরতায় প্রতিফলিত হয়। পরে ঢাকায় চলে আসেন এবং অভিনয়ের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে শুরু করেন মিডিয়ায় পথচলা।
চলচ্চিত্রে আগমন ও অভিনয়ের শক্তি
পরীমণির চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে ২০১৫ সালে ‘ভালোবাসা সীমাহীন’ ছবির মাধ্যমে। তবে দর্শকের কাছে পরিচিতি পান ‘রানা প্লাজা’ সিনেমা দিয়ে, যেখানে তিনি একটি সত্য কাহিনির প্রেক্ষাপটে অসাধারণ অভিনয় করেন। একের পর এক ছবিতে তাকে দেখা গেছে বিভিন্ন চরিত্রে—চলচ্চিত্রের নায়িকা, প্রেমিকা, প্রতিবাদী নারী, সংগ্রামী মা—যেখানে তার আবেগপ্রবণ সংলাপ, চোখের ভাষা ও শরীরী অভিব্যক্তি প্রশংসা কুড়িয়েছে।
তিনি অভিনয়ে এমন এক শক্তি দেখিয়েছেন, যা একদিকে যেমন দর্শকের হৃদয় স্পর্শ করে, অন্যদিকে পরিচালক-প্রযোজকদের ভরসার জায়গাও হয়ে ওঠে। ‘সুইটহার্ট’, ‘স্বপ্নজাল’, ‘গুণিন’ কিংবা ‘বিশ্বসুন্দরী’র মতো ছবিতে তার বহুমাত্রিক অভিনয়শৈলী বারবার আলোচিত হয়েছে।
বিতর্ক ও স্ক্যান্ডাল
তবে পরীমণির ক্যারিয়ারটা শুধুই রঙিন আলোর গল্প নয়। মাঝেমধ্যে তাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে নানা বিতর্ক। ২০২১ সালের মাঝামাঝি ঢাকার একটি বারে তাকে নিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার মাধ্যমে তিনি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। এরপর মাদক মামলায় গ্রেফতার হন, যা তাকে মানসিক ও সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। তিনি দাবি করেছিলেন, এ ঘটনা তার বিরুদ্ধে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। এই সময়েই ব্যাপক জনসমর্থনও পান তিনি, বিশেষ করে নারীদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হওয়ার কারণে।
মানবিক ও সমাজসেবামূলক কাজ
বিতর্কের পাশাপাশি তার মানবিক দিকও প্রকাশ পেয়েছে বারবার। করোনা মহামারির সময় পরীমণি বিভিন্ন চলচ্চিত্র কলাকুশলীদের সহায়তা করেছেন, আর্থিক সাহায্য করেছেন অসচ্ছল শিল্পী ও কর্মীদের। শিশুদের সুরক্ষা, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার অবস্থান নিয়েছেন সামাজিক মাধ্যমে। নারীর প্রতি সহিংসতা বা সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে তার অবস্থান ও বক্তব্য বারবার প্রশংসিত হয়েছে।
ব্যক্তিগত জীবন ও বিবাহ
পরীমণির ব্যক্তিগত জীবনও ছিল অনেক চড়াই-উতরাইয়ের গল্প। ২০২১ সালে তিনি অভিনেতা শরিফুল রাজের সঙ্গে প্রেমে জড়ান এবং পরে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের ঘরে রাজ্য নামে একটি পুত্র সন্তান রয়েছে। এই দাম্পত্য জীবনও পরবর্তীতে নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে। ২০২৩ সালের শেষের দিকে তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার খবর প্রকাশ পায়, যা পরীমণির ব্যক্তিগত জীবনে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করে।
পুরস্কার ও সম্মাননা
পরীমণির ঝুলিতে রয়েছে একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা। ‘বিশ্বসুন্দরী’ ছবির জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে মনোনীত হন। এছাড়া মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারেও তিনি মনোনীত হয়েছেন একাধিকবার। তার অভিনয় নৈপুণ্য ও জনপ্রিয়তা মিলিয়ে তিনি নিজেকে ঢালিউডের অন্যতম শীর্ষ অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন।
আলো ও অন্ধকারের এক নায়িকা
পরীমণির জীবন একদিকে যেমন সংগ্রামের, অন্যদিকে বিতর্কের। তবে এসবের বাইরেও তিনি একজন সাহসী নারী, একজন শিল্পী, যিনি নিজের অবস্থান থেকে সমাজের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেছেন। অভিনয়ের মাধ্যমে যে আবেগ ও শক্তি তিনি ছড়িয়ে দেন, তা অনন্য। ব্যক্তিজীবনে যতই ঝড় আসুক, পরীমণি এখনও রয়ে গেছেন বাংলাদেশের সমকালীন চলচ্চিত্রের আলোচিত মুখ, এক অসমাপ্ত কিন্তু প্রতিশ্রুতিশীল অধ্যায়।