০৯:৫৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২০ জুলাই ২০২৫

সামাজিক মাধ্যমে রসিকতা: মানসিক স্বস্তি না বিভ্রান্তির কারণ?

রসিকতা: এক অনন্য মানবিক গুণ

রসিকতা বা হিউমার মানুষের এক অনন্য গুণ। এটি শুধু আনন্দের মাধ্যম নয়, বরং মানসিক চাপের এক প্রাকৃতিক নিরসন। যখন মানুষ দৈনন্দিন জীবনের শত চাপ, ক্লান্তি এবং উদ্বেগে আক্রান্ত, তখন একটি সহজাত রসিকতা মুহূর্তেই হালকা করে দেয় মন। চেহারায় ফুটে ওঠে স্বস্তির হাসি। তাই মানব সভ্যতার ইতিহাসে রসিকতা বরাবরই ছিল সমাজে বন্ধনের উপাদান, মানুষের মনের ভার লাঘবের হাতিয়ার।যেমন কেউ হয়তো প্রচন্ড গরমের ভেতর ছিলো তখন বলা হলো, আসলে এখানকার এসির( এয়ারকুলারের) বাতাসটি খুব সুন্দর। বা কেউ সারাদিন না খেয়ে থাকার পরে বললেন, আজই সব থেকে ভালো খাবারটি খেলাম।

চাপের পৃথিবীতে রসিকতা এক চাবিকাঠি

বর্তমান বিশ্বে প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনো মানসিক চাপের শিকার। অফিসের কাজ, পারিবারিক টানাপোড়েন, অর্থনৈতিক সমস্যা কিংবা ব্যক্তিগত সম্পর্কের জটিলতা—সবকিছুর মাঝেই মানুষ খুঁজে ফেরে কিছুটা নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশ। সেখানে একটি রসিক মিম, ভিডিও অথবা একটি ব্যঙ্গাত্মক ফেসবুক স্ট্যাটাসই পারে মুহূর্তে মানসিক অবকাশ এনে দিতে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মানুষ নিয়মিত হাসে বা রসিকতায় অংশগ্রহণ করে, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য তুলনামূলক ভালো থাকে।

সামাজিক মাধ্যমে রসিকতার বিস্ফোরণ

সামাজিক মাধ্যম—বিশেষ করে ফেসবুক, টিকটক, ইউটিউব বা ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো রসিকতা বা ব্যঙ্গাত্মক কনটেন্টের এক বিশাল জগৎ তৈরি করেছে। আজকাল সাধারণ মানুষ নিজের অভিজ্ঞতা, দুঃখ-কষ্ট কিংবা সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে ব্যঙ্গাত্মকভাবে প্রকাশ করে। এতে সমাজের নানা সমস্যাও চিহ্নিত হচ্ছে, আবার একইসঙ্গে মানুষ কিছুটা হেসে হালকা হতে পারছে। এই রসিকতাগুলো অনেক সময় রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় কিংবা ব্যক্তিগত বিষয়কে কেন্দ্র করেও হতে পারে। তবে মূল উদ্দেশ্য থাকে বিনোদন এবং চিন্তার খোরাক জোগানো।

রসিকতায় কেন কেউ কেউ রেগে যান?

তবে সব মানুষেরই এই রসিকতাকে সাদরে গ্রহণ করার মানসিক প্রস্তুতি থাকে না। বরং দেখা যায়, অনেকেই রসিকতামূলক স্ট্যাটাস বা কনটেন্টে রেগে যান, প্রতিবাদ করেন, কখনো কখনো গালাগালিও করেন। এই আচরণের পেছনে রয়েছে মনোবৈজ্ঞানিক কিছু ব্যাখ্যা।

আত্মপরিচয় ও আত্মরক্ষার প্রবৃত্তি

মানবমনের একটি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হলো, সে নিজেকে বা তার বিশ্বাসকে হুমকির সম্মুখীন মনে করলে আত্মরক্ষার মনোভাব দেখায়। যখন একটি রসিকতা কারও রাজনৈতিক মতাদর্শ, ধর্মীয় বিশ্বাস, জাতিগত পরিচয় বা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে ছুঁয়ে যায়, তখন সে তা অপমান বা আঘাত হিসেবে গ্রহণ করে। ফলে তার প্রতিক্রিয়া হয় রাগ বা বিরক্তি।

কম রসবোধ ও আবেগ নিয়ন্ত্রণে ঘাটতি

মানসিকভাবে স্থিতিশীল এবং আত্মবিশ্বাসী ব্যক্তিরা সাধারণত রসিকতাকে সহজভাবে নিতে পারে। কিন্তু যাদের আত্মসম্মানজনিত সংকট, অবদমন, অথবা অতিরিক্ত আবেগপ্রবণতা থাকে, তারা একটি সাধারণ ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্যকেও নিজের প্রতি আক্রমণ হিসেবে নেন। এটি রসবোধের অভাব এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতার প্রতিফলন।

সংকীর্ণ মানসিকতা ও তথ্যপ্রবাহে সীমাবদ্ধতা

অনেক সময় দেখা যায়, যারা রসিকতায় রেগে যান, তারা একটি নির্দিষ্ট চিন্তাধারায় আটকে থাকেন এবং সমালোচনামূলক ভাবনার সুযোগ রাখেন না। এই সংকীর্ণ মানসিকতা রসিকতার বহুমাত্রিক দিক অনুধাবনে ব্যর্থ হয় এবং যে কোনো ব্যঙ্গকে ‘অপমান’ হিসেবে বিবেচনা করে।

Does the art world have a sense of humour? - Apollo Magazine

সমাজে রসিকতা ও সহনশীলতার ভারসাম্য জরুরি

যেকোনো সমাজে রসিকতা যেমন দরকার, তেমনি দরকার সহনশীলতা ও সংবেদনশীলতা। রসিকতা যেন কারও প্রতি হিংসা, বিদ্বেষ বা অপমান না হয়, সেটাও খেয়াল রাখা জরুরি। একইসঙ্গে যারা রসিকতা গ্রহণে অক্ষম, তাদেরও বুঝতে হবে—সবকিছু ব্যক্তিগতভাবে নেওয়া মানেই নিজের মানসিক শান্তি ধ্বংস করা।

জীবনের স্বস্তি

রসিকতা একটি শিল্প, জীবনের স্বস্তির ভাষা। এটিকে উপভোগ করতে শিখলে সমাজ হবে আরও মানবিক, আরও আনন্দময়। তবে একে গ্রহণ করার জন্য চাই মন ও মস্তিষ্কের প্রশস্ততা, চাই আত্মবিশ্বাস ও স্থিতিশীলতা। সামাজিক মাধ্যম হোক মুক্ত হাসির মঞ্চ, যেখানে সব ভিন্নতা হাস্যরসের মধ্য দিয়ে মিলবে এক মানবিক বন্ধনে।

সামাজিক মাধ্যমে রসিকতা: মানসিক স্বস্তি না বিভ্রান্তির কারণ?

০৫:০০:৫৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫

রসিকতা: এক অনন্য মানবিক গুণ

রসিকতা বা হিউমার মানুষের এক অনন্য গুণ। এটি শুধু আনন্দের মাধ্যম নয়, বরং মানসিক চাপের এক প্রাকৃতিক নিরসন। যখন মানুষ দৈনন্দিন জীবনের শত চাপ, ক্লান্তি এবং উদ্বেগে আক্রান্ত, তখন একটি সহজাত রসিকতা মুহূর্তেই হালকা করে দেয় মন। চেহারায় ফুটে ওঠে স্বস্তির হাসি। তাই মানব সভ্যতার ইতিহাসে রসিকতা বরাবরই ছিল সমাজে বন্ধনের উপাদান, মানুষের মনের ভার লাঘবের হাতিয়ার।যেমন কেউ হয়তো প্রচন্ড গরমের ভেতর ছিলো তখন বলা হলো, আসলে এখানকার এসির( এয়ারকুলারের) বাতাসটি খুব সুন্দর। বা কেউ সারাদিন না খেয়ে থাকার পরে বললেন, আজই সব থেকে ভালো খাবারটি খেলাম।

চাপের পৃথিবীতে রসিকতা এক চাবিকাঠি

বর্তমান বিশ্বে প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনো মানসিক চাপের শিকার। অফিসের কাজ, পারিবারিক টানাপোড়েন, অর্থনৈতিক সমস্যা কিংবা ব্যক্তিগত সম্পর্কের জটিলতা—সবকিছুর মাঝেই মানুষ খুঁজে ফেরে কিছুটা নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশ। সেখানে একটি রসিক মিম, ভিডিও অথবা একটি ব্যঙ্গাত্মক ফেসবুক স্ট্যাটাসই পারে মুহূর্তে মানসিক অবকাশ এনে দিতে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মানুষ নিয়মিত হাসে বা রসিকতায় অংশগ্রহণ করে, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য তুলনামূলক ভালো থাকে।

সামাজিক মাধ্যমে রসিকতার বিস্ফোরণ

সামাজিক মাধ্যম—বিশেষ করে ফেসবুক, টিকটক, ইউটিউব বা ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো রসিকতা বা ব্যঙ্গাত্মক কনটেন্টের এক বিশাল জগৎ তৈরি করেছে। আজকাল সাধারণ মানুষ নিজের অভিজ্ঞতা, দুঃখ-কষ্ট কিংবা সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে ব্যঙ্গাত্মকভাবে প্রকাশ করে। এতে সমাজের নানা সমস্যাও চিহ্নিত হচ্ছে, আবার একইসঙ্গে মানুষ কিছুটা হেসে হালকা হতে পারছে। এই রসিকতাগুলো অনেক সময় রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় কিংবা ব্যক্তিগত বিষয়কে কেন্দ্র করেও হতে পারে। তবে মূল উদ্দেশ্য থাকে বিনোদন এবং চিন্তার খোরাক জোগানো।

রসিকতায় কেন কেউ কেউ রেগে যান?

তবে সব মানুষেরই এই রসিকতাকে সাদরে গ্রহণ করার মানসিক প্রস্তুতি থাকে না। বরং দেখা যায়, অনেকেই রসিকতামূলক স্ট্যাটাস বা কনটেন্টে রেগে যান, প্রতিবাদ করেন, কখনো কখনো গালাগালিও করেন। এই আচরণের পেছনে রয়েছে মনোবৈজ্ঞানিক কিছু ব্যাখ্যা।

আত্মপরিচয় ও আত্মরক্ষার প্রবৃত্তি

মানবমনের একটি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হলো, সে নিজেকে বা তার বিশ্বাসকে হুমকির সম্মুখীন মনে করলে আত্মরক্ষার মনোভাব দেখায়। যখন একটি রসিকতা কারও রাজনৈতিক মতাদর্শ, ধর্মীয় বিশ্বাস, জাতিগত পরিচয় বা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে ছুঁয়ে যায়, তখন সে তা অপমান বা আঘাত হিসেবে গ্রহণ করে। ফলে তার প্রতিক্রিয়া হয় রাগ বা বিরক্তি।

কম রসবোধ ও আবেগ নিয়ন্ত্রণে ঘাটতি

মানসিকভাবে স্থিতিশীল এবং আত্মবিশ্বাসী ব্যক্তিরা সাধারণত রসিকতাকে সহজভাবে নিতে পারে। কিন্তু যাদের আত্মসম্মানজনিত সংকট, অবদমন, অথবা অতিরিক্ত আবেগপ্রবণতা থাকে, তারা একটি সাধারণ ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্যকেও নিজের প্রতি আক্রমণ হিসেবে নেন। এটি রসবোধের অভাব এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতার প্রতিফলন।

সংকীর্ণ মানসিকতা ও তথ্যপ্রবাহে সীমাবদ্ধতা

অনেক সময় দেখা যায়, যারা রসিকতায় রেগে যান, তারা একটি নির্দিষ্ট চিন্তাধারায় আটকে থাকেন এবং সমালোচনামূলক ভাবনার সুযোগ রাখেন না। এই সংকীর্ণ মানসিকতা রসিকতার বহুমাত্রিক দিক অনুধাবনে ব্যর্থ হয় এবং যে কোনো ব্যঙ্গকে ‘অপমান’ হিসেবে বিবেচনা করে।

Does the art world have a sense of humour? - Apollo Magazine

সমাজে রসিকতা ও সহনশীলতার ভারসাম্য জরুরি

যেকোনো সমাজে রসিকতা যেমন দরকার, তেমনি দরকার সহনশীলতা ও সংবেদনশীলতা। রসিকতা যেন কারও প্রতি হিংসা, বিদ্বেষ বা অপমান না হয়, সেটাও খেয়াল রাখা জরুরি। একইসঙ্গে যারা রসিকতা গ্রহণে অক্ষম, তাদেরও বুঝতে হবে—সবকিছু ব্যক্তিগতভাবে নেওয়া মানেই নিজের মানসিক শান্তি ধ্বংস করা।

জীবনের স্বস্তি

রসিকতা একটি শিল্প, জীবনের স্বস্তির ভাষা। এটিকে উপভোগ করতে শিখলে সমাজ হবে আরও মানবিক, আরও আনন্দময়। তবে একে গ্রহণ করার জন্য চাই মন ও মস্তিষ্কের প্রশস্ততা, চাই আত্মবিশ্বাস ও স্থিতিশীলতা। সামাজিক মাধ্যম হোক মুক্ত হাসির মঞ্চ, যেখানে সব ভিন্নতা হাস্যরসের মধ্য দিয়ে মিলবে এক মানবিক বন্ধনে।