বাস্তিল দিবসে প্যারিসের জাঁকজমকপূর্ণ কুচকাওয়াজ
২০২৫ সালের ১৪ জুলাই, ফ্রান্সের ঐতিহাসিক বাস্তিল দিবস উপলক্ষে প্যারিস শহর আবারও রাঙিয়ে উঠেছিল লাল, সাদা ও নীল রঙে। ফরাসি বিপ্লবের স্মরণে আয়োজিত বার্ষিক সামরিক কুচকাওয়াজ ও আতশবাজির এই অনুষ্ঠান শুধু ফ্রান্সের সামরিক শক্তির প্রদর্শনী নয়, বরং ফরাসি প্রজাতন্ত্রের ইতিহাস ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। এদিন প্রায় ৭০০০ সেনা সদস্য, ২০০টি ঘোড়া এবং ১০০টিরও বেশি সামরিক বিমান ও হেলিকপ্টার এই মহাযজ্ঞে অংশ নেয়।
ট্রাম্পের অনুপ্রেরণা বাস্তিল দিবস
২০১৭ সালে তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর আমন্ত্রণে এই কুচকাওয়াজে অংশ নেন। তিনি একে নিজের দেখা ‘সবচেয়ে চমৎকার কুচকাওয়াজ’ বলে অভিহিত করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রেও এমন কিছু আয়োজনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। অবশেষে তার দ্বিতীয় মেয়াদে, ২০২৫ সালের ১৪ জুন—ট্রাম্পের জন্মদিনেই—ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্কিন সেনাবাহিনীর ২৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সামরিক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়।
ম্যাক্রোঁর নেতৃত্বে এবারের আয়োজন
এই বছরের বাস্তিল দিবস কুচকাওয়াজ শুরু হয় প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর আগমনের মাধ্যমে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ফরাসি সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান থিয়েরি বুরকার্ড এবং প্যারিসের সামরিক গভর্নর লোইক মিজঁ। রিপাবলিকান গার্ডের অশ্বারোহীরা তাঁকে ঘোড়ায় চড়ে শহরের মধ্য দিয়ে নিয়ে যান।
ইতিহাসে বাস্তিল দিবসের তাৎপর্য
১৮৮০ সালে প্রথমবারের মতো বাস্তিল দিবসের কুচকাওয়াজ আয়োজন করা হয় ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্রের শাসনব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে। ১৮৭০ সালে ফ্রাঙ্কো-জার্মান যুদ্ধে নেপোলিয়ন তৃতীয় পরাজিত হওয়ার পর দ্বিতীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। তখন থেকেই ১৪ জুলাই ফ্রান্সে বিপ্লব এবং প্রজাতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে।
প্যারিস ও ওয়াশিংটন: কুচকাওয়াজের প্রতিচ্ছবি
প্যারিসের এই মহা আয়োজনে আইফেল টাওয়ার, আর্ক দ্য ত্রিয়ঁফ এবং মঁমার্ত্রের সাক্র কোরের মতো বিখ্যাত স্থাপনাগুলোর পটভূমিতে আকাশে উড়ে ১০২টি বিমান ও হেলিকপ্টার। অনেকে আকাশে ধোঁয়া ছেড়ে ফরাসি পতাকার রঙের প্রতীক ফুটিয়ে তোলেন। একইভাবে, ওয়াশিংটনের সামরিক কুচকাওয়াজও লিঙ্কন মেমোরিয়াল থেকে শুরু হয়ে কনস্টিটিউশন অ্যাভিনিউ ও ন্যাশনাল মল হয়ে হোয়াইট হাউস এবং ওয়াশিংটন মনুমেন্টের পাশ দিয়ে অগ্রসর হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের কুচকাওয়াজে অংশ নেয় প্রায় ৬৭০০ সেনা, যাঁদের অনেকেই ইতিহাসের বিভিন্ন যুদ্ধের স্মরণে ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরেছিলেন। ফ্রান্সেও সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ, দমকল বাহিনী, সামরিক স্কুলের ছাত্র এবং স্বেচ্ছাসেবীদের সমন্বয়ে বিশাল কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়।
ইন্দোনেশিয়ার অংশগ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
এ বছর ইন্দোনেশিয়া কুচকাওয়াজে বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশ নেয়। দেশটির প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তো নিজে উপস্থিত থেকে ফরাসি সেনাদের সঙ্গে ৪৫০ জন ইন্দোনেশীয় সেনা ও ড্রাম ব্যান্ড সদস্যদের কুচকাওয়াজ প্রত্যক্ষ করেন। এই অংশগ্রহণ আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্ককে নতুন মাত্রা দেয়।
সাধারণ মানুষের আগ্রহ ও প্রতিক্রিয়া
প্রতি বছর কোটি মানুষ চ্যাম্প-এলিসিতে জড়ো হয়ে বাস্তিল দিবসের কুচকাওয়াজ উপভোগ করেন। প্যারিসে এই আয়োজন নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হলেও এক পর্যায়ে একটি ঘোড়া রাস্তার ওপর পড়ে গেলে তার অশ্বারোহী—রিপাবলিকান গার্ডের সদস্য—মাটিতে পড়ে যান।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে কুচকাওয়াজের জন্য প্রায় ২৫ থেকে ৪৫ মিলিয়ন ডলার খরচ হয় বলে সেনাবাহিনী জানিয়েছে। এ নিয়ে ‘নো কিংস’ শীর্ষক প্রতিবাদও হয় দেশজুড়ে, যেখানে সমালোচকরা ট্রাম্পের জন্মদিনে সামরিক কুচকাওয়াজ আয়োজনকে কর্তৃত্ববাদী শাসনের ইঙ্গিত হিসেবে আখ্যা দেন এবং একে উত্তর কোরিয়ার মতো কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করেন।
আতশবাজি ও প্রযুক্তির সম্মিলন
রাতের আকাশে বাস্তিল দিবস শেষ হয় বিশাল আতশবাজি প্রদর্শনীর মাধ্যমে, যা আয়োজিত হয় আইফেল টাওয়ারের সামনে। এ বছর এর সঙ্গে যুক্ত হয় প্রায় ১০০০ ড্রোনের শো, যেখানে “স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব” শব্দগুলো লেখা এবং প্যারিস শহরের প্রতীক ফুটিয়ে তোলা হয়।
এই উৎসব শুধু একটি ঐতিহ্য নয়, বরং ফ্রান্সের সামরিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে বিশ্বের সামনে তুলে ধরার অন্যতম উপায়। আবার এটিই সেই আয়োজন, যা একসময় অনুপ্রাণিত করেছিল হোয়াইট হাউসকেও।