ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় চালুর সিদ্ধান্ত
বাংলাদেশ সরকার এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হিসেবে ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের (OHCHR) একটি আঞ্চলিক কার্যালয় স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত দেশের মানবাধিকার কাঠামোকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সংযুক্ত করার পাশাপাশি বিভিন্ন ইস্যুতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার এক বড় অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং আশাবাদ প্রকাশ করেছেন যে, এই কার্যালয় দক্ষিণ এশিয়ার মানবাধিকার উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।
কোন কোন দেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় রয়েছে?
বাংলাদেশ ছাড়াও বর্তমানে বিশ্বের ১২টি দেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের অফিস (OHCHR) সরাসরি অফিস স্থাপন করে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এই নিম্নোক্ত দেশগুলো হচ্ছে:
১. আফগানিস্তান
২. কঙ্গো (ডিআরসি)
৩. গিনি
৪. মালি
৫. সুদান
৬. উগান্ডা
৭. কেনিয়া
৮. মেক্সিকো
৯. প্যালেস্টাইন অঞ্চল (ওয়েস্ট ব্যাংক ও গাজা)
১০. সেনেগাল (ফ্রান্সোফোন আফ্রিকার আঞ্চলিক অফিস)
১১. বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা
১২. টিমোর-লেস্টে
প্রতিটি দেশেই কার্যালয় স্থাপনের পেছনে জাতিসংঘের উদ্দেশ্য হলো মানবাধিকার পরিস্থিতির তত্ত্বাবধান, নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ এবং সরকারের সঙ্গে মানবাধিকার সংরক্ষণের বিষয়ে সহায়তা প্রদান।
এই দেশগুলোর আইন-শৃঙ্খলা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি
নেপাল
দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের পর এখনও ‘ট্রানজিশনাল জাস্টিস’ (সংক্রমণকালীন ন্যায়বিচার) প্রক্রিয়া চলছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে, বিশেষ করে রাজনৈতিক বিচার বিলম্বিত হওয়ায়; তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আইনের শাসন কিছুটা উন্নত হয়েছে।
আফগানিস্তান
তালেবান শাসনের অধীনে নারী অধিকার চরমভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছে। সাংবাদিকদের স্বাধীনতা, শিক্ষা ও সংখ্যালঘু অধিকার ব্যাপকভাবে সীমিত। জাতিসংঘের জন্য এটি অন্যতম চ্যালেঞ্জিং কর্মপরিকল্পনা ক্ষেত্র।
কঙ্গো (ডিআরসি)
সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সহিংসতা ও দুর্বল বিচারব্যবস্থা মানবাধিকার পরিস্থিতিকে নাজুক করে তুলেছে। জাতিসংঘের কার্যালয় এখানে যুদ্ধাপরাধ ও নির্যাতন পর্যবেক্ষণে কাজ করছে।
গিনি
রাজনৈতিক উত্তেজনা, নিরাপত্তা বাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ এবং গণতন্ত্রবিরোধী প্রবণতার কারণে গিনিতে মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।
সুদান
সাম্প্রতিক সেনা অভ্যুত্থান ও সংঘর্ষ দেশটিকে মানবিক ও আইন-শৃঙ্খলার চরম সংকটে ফেলেছে। OHCHR যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো নথিভুক্ত করছে।
উগান্ডা
বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের দমন, এলজিবিটি অধিকার হরণ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সহিংসতায় জাতিসংঘের উপস্থিতি সেখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
কেনিয়া
যদিও আইন-শৃঙ্খলা তুলনামূলক স্থিতিশীল, তবুও নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা এবং পুলিশি নির্যাতনের অভিযোগ থেকে দেশটি পুরোপুরি মুক্ত নয়।
মেক্সিকো
ড্রাগ কার্টেলের সহিংসতা, জবাবদিহিতার অভাব এবং নারীর প্রতি অপরাধের কারণে জাতিসংঘের সক্রিয় পর্যবেক্ষণ জরুরি হয়েছে।
প্যালেস্টাইন (ওয়েস্ট ব্যাংক ও গাজা)
ইসরায়েলি দখল, সংঘর্ষ ও মানবিক সংকটের ফলে এই অঞ্চলে জাতিসংঘের বিশেষ তৎপরতা রয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়মিত আলোচনার বিষয়।
সেনেগাল
মূলত ফ্রান্সোফোন আফ্রিকার দেশগুলোর জন্য আঞ্চলিক অফিস হিসেবে কাজ করে। প্রবাসী শ্রমিক, নারীর অধিকার ও দুর্নীতিবিরোধী প্রচারণায় সক্রিয়।
বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা
যুদ্ধপরবর্তী পুনর্গঠন ও জাতিগত সহিংসতা পর্যালোচনায় জাতিসংঘের বিশেষ মনোযোগ অব্যাহত রয়েছে।
টিমোর-লেস্টে
স্বাধীনতা-পরবর্তী মানবাধিকার কাঠামো উন্নয়নে জাতিসংঘ সহায়তা করছে। আইনের শাসন সুদৃঢ়করণ এখানকার প্রধান চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশে কার্যালয় স্থাপনের প্রভাব
ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে। সরকার ও বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থার মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতা বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি নিখোঁজ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সাংবাদিক নির্যাতন, শ্রমিক অধিকারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে জাতিসংঘ সরাসরি পর্যবেক্ষণ, কারিগরি সহায়তা ও পরামর্শ দিতে পারবে—যা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।