০৭:৫৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ২০ জুলাই ২০২৫

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিদের প্রবেশ থেকে জিম্মিদের মৃত্যুর শেষ দৃশ্য

ভয়াবহ রাতের শুরু: সন্ত্রাসীদের প্রবেশ

২০১৬ সালের ১ জুলাই শুক্রবার রাত আনুমানিক ৮টা ৪৫ মিনিট। তখন গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের অভিজাত ও আন্তর্জাতিক মানের রেস্তোরাঁ ‘হলি আর্টিজান বেকারি’ ছিল উৎসবমুখর। দেশি-বিদেশি অতিথি, কূটনীতিক, ব্যবসায়ী ও তরুণ-তরুণীরা খাবার উপভোগ করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ কয়েকজন তরুণ—যারা তখন সাধারণ পোশাকে ছিল—রেস্তোরাঁর মূল ফটকের দিকে এগিয়ে আসে। নিরাপত্তারক্ষীদের বাধা উপেক্ষা করে বা কখনো ঠেলে সরিয়ে দিয়ে তারা ঢুকে পড়ে ভেতরে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় গুলির শব্দ। এরপর ছোড়া হয় গ্রেনেড, বোমা। মুহূর্তেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।

রক্তাক্ত বন্দীদশা: কাস্টমার ও কর্মচারীদের জিম্মি করা

সন্ত্রাসীরা ঢুকেই রেস্তোরাঁর ভেতরে থাকা প্রায় ৪০-৪৫ জনকে জিম্মি করে ফেলে। এদের মধ্যে ছিল ইতালীয়, জাপানি, ভারতীয়, শ্রীলঙ্কান নাগরিক, কূটনৈতিক প্রতিনিধি, কয়েকজন বাংলাদেশি এবং রেস্তোরাঁর কর্মীরা। জঙ্গিরা সঙ্গে সঙ্গে নারীদের আলাদা করে দেয়, বিদেশি চেহারার মানুষদের শনাক্ত করে তাদের পরিচয়পত্র দেখতে চায়। যাদের মুসলমান মনে হয়নি, বা যারা কোরআনের আয়াত মুখস্থ বলতে পারেনি, তাদের ওপর চাপ বাড়ানো হয়।

সন্ত্রাসীদের পরিকল্পিত জিজ্ঞাসাবাদ ও ধর্ম পরীক্ষা

জিম্মিদের সঙ্গে জঙ্গিরা কথা বলেছে অত্যন্ত নির্দিষ্ট ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে। তারা জিজ্ঞেস করেছে—

  • ‘তুমি মুসলমান?’
  • ‘তুমি নামাজ পড়ো?’
  • ‘তুমি কোরআনের কোন সূরা বলতে পারো?’

যারা উত্তরে দ্বিধা করেছে, তাদের প্রতি অবিশ্বাস দেখানো হয়েছে। অনেককে বাধ্য করা হয়েছে কোরআন তেলাওয়াত করতে। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যেই তারা নিজেরা চিৎকার করে বলেছে, ‘আমরা আইএস, আমরা খেলাফত প্রতিষ্ঠা করবো।’

জিম্মিদের প্রতি নিষ্ঠুরতা: বেঁধে রাখানির্যাতনহত্যা

রাত গভীর হতে থাকলেও ভয়াবহতা থামেনি। অনেক জিম্মিকে বেঁধে রাখা হয় হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায়। খাবার ও পানি দিতে অস্বীকৃতি জানায় সন্ত্রাসীরা। কাউকে কাউকে হত্যা করার আগে ভয় দেখানো হয়, আবার কারও সামনে একজনকে হত্যা করে অপরজনকে ভয় দেখায়। অধিকাংশ বিদেশিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা কেটে হত্যা করা হয়। পরে ফরেনসিক রিপোর্টে জানা যায়, অধিকাংশ নিহতের শরীরে জখমের চিহ্ন ছিল, যা ধারালো অস্ত্রের।

এই ভয়াল রাতে মোট ২০ জন জিম্মিকে হত্যা করে জঙ্গিরা। তাদের মধ্যে ৯ জন ইতালীয়, ৭ জন জাপানি, ১ জন ভারতীয়, ৩ জন বাংলাদেশি ছিলেন।

রাতভর আতঙ্কসকালবেলায় অভিযান

জঙ্গিরা রেস্তোরাঁ দখল করে রাখে পুরো রাত। মাঝে মাঝে সোশ্যাল মিডিয়ায় আইএস-এর পক্ষ থেকে ছবি প্রকাশ করা হয় ভেতরের। তারা আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে দাবি করে যে, এটি ‘ইসলামিক স্টেট’-এর হামলা। রাতভর আলোচনার পর ২ জুলাই ভোর ৭টার দিকে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ‘থান্ডারবোল্ট’ নামের বিশেষ অভিযান শুরু হয়।

মাত্র ১২ মিনিটের অভিযানে ৫ জন সন্ত্রাসী নিহত হয়, ১ জন ধরা পড়ে এবং রেস্তোরাঁর ভেতর থাকা ১৩ জন জিম্মিকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।

সন্দেহভাজন অতিথি: একজন রহস্যময় গ্রাহকের উপস্থিতি

সেদিনের রাতে রেস্তোরাঁয় থাকা অতিথিদের মধ্যে একজন রহস্যময় ব্যক্তি ছিলেন, যার নাম উঠে আসে পরবর্তীতে তদন্তে—তাহমিদ হাসিব খান, কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ টরন্টোর ছাত্র। প্রথমে তিনি সন্দেহের তালিকায় ছিলেন, কারণ ঘটনাস্থল থেকে তাকে জীবিত উদ্ধার করা হলেও তার বক্তব্য ছিল অসংলগ্ন। তাকে গ্রেপ্তারও করা হয়, পরে অবশ্য তদন্তে তার সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রমাণ মেলেনি এবং তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

জাতির ঘুম ভাঙানো রাত

হলি আর্টিজানের সেই রাতটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর জঙ্গি হামলার প্রতীক হয়ে আছে। এটি শুধু দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা নয়, বরং আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের প্রভাব, তরুণদের বিপথগামীতা, এবং ধর্মীয় চরমপন্থার ভয়ঙ্কর রূপ তুলে ধরেছে। অনেক পরিবার হারিয়েছে তাদের প্রিয়জন, আবার কেউ কেউ সারাজীবন বয়ে বেড়াবে সেই বিভীষিকার ক্ষত।

এই ঘটনায় প্রাণ হারানো মানুষদের স্মরণে আজো ওই জায়গায় নিরাপত্তা সিঁড়ি, স্মৃতিফলক, শান্ত পরিবেশ গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের ওই কালো রাত দেশের মননে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে।

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিদের প্রবেশ থেকে জিম্মিদের মৃত্যুর শেষ দৃশ্য

০৩:২৪:৫০ অপরাহ্ন, রবিবার, ২০ জুলাই ২০২৫

ভয়াবহ রাতের শুরু: সন্ত্রাসীদের প্রবেশ

২০১৬ সালের ১ জুলাই শুক্রবার রাত আনুমানিক ৮টা ৪৫ মিনিট। তখন গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের অভিজাত ও আন্তর্জাতিক মানের রেস্তোরাঁ ‘হলি আর্টিজান বেকারি’ ছিল উৎসবমুখর। দেশি-বিদেশি অতিথি, কূটনীতিক, ব্যবসায়ী ও তরুণ-তরুণীরা খাবার উপভোগ করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ কয়েকজন তরুণ—যারা তখন সাধারণ পোশাকে ছিল—রেস্তোরাঁর মূল ফটকের দিকে এগিয়ে আসে। নিরাপত্তারক্ষীদের বাধা উপেক্ষা করে বা কখনো ঠেলে সরিয়ে দিয়ে তারা ঢুকে পড়ে ভেতরে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় গুলির শব্দ। এরপর ছোড়া হয় গ্রেনেড, বোমা। মুহূর্তেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।

রক্তাক্ত বন্দীদশা: কাস্টমার ও কর্মচারীদের জিম্মি করা

সন্ত্রাসীরা ঢুকেই রেস্তোরাঁর ভেতরে থাকা প্রায় ৪০-৪৫ জনকে জিম্মি করে ফেলে। এদের মধ্যে ছিল ইতালীয়, জাপানি, ভারতীয়, শ্রীলঙ্কান নাগরিক, কূটনৈতিক প্রতিনিধি, কয়েকজন বাংলাদেশি এবং রেস্তোরাঁর কর্মীরা। জঙ্গিরা সঙ্গে সঙ্গে নারীদের আলাদা করে দেয়, বিদেশি চেহারার মানুষদের শনাক্ত করে তাদের পরিচয়পত্র দেখতে চায়। যাদের মুসলমান মনে হয়নি, বা যারা কোরআনের আয়াত মুখস্থ বলতে পারেনি, তাদের ওপর চাপ বাড়ানো হয়।

সন্ত্রাসীদের পরিকল্পিত জিজ্ঞাসাবাদ ও ধর্ম পরীক্ষা

জিম্মিদের সঙ্গে জঙ্গিরা কথা বলেছে অত্যন্ত নির্দিষ্ট ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে। তারা জিজ্ঞেস করেছে—

  • ‘তুমি মুসলমান?’
  • ‘তুমি নামাজ পড়ো?’
  • ‘তুমি কোরআনের কোন সূরা বলতে পারো?’

যারা উত্তরে দ্বিধা করেছে, তাদের প্রতি অবিশ্বাস দেখানো হয়েছে। অনেককে বাধ্য করা হয়েছে কোরআন তেলাওয়াত করতে। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যেই তারা নিজেরা চিৎকার করে বলেছে, ‘আমরা আইএস, আমরা খেলাফত প্রতিষ্ঠা করবো।’

জিম্মিদের প্রতি নিষ্ঠুরতা: বেঁধে রাখানির্যাতনহত্যা

রাত গভীর হতে থাকলেও ভয়াবহতা থামেনি। অনেক জিম্মিকে বেঁধে রাখা হয় হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায়। খাবার ও পানি দিতে অস্বীকৃতি জানায় সন্ত্রাসীরা। কাউকে কাউকে হত্যা করার আগে ভয় দেখানো হয়, আবার কারও সামনে একজনকে হত্যা করে অপরজনকে ভয় দেখায়। অধিকাংশ বিদেশিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা কেটে হত্যা করা হয়। পরে ফরেনসিক রিপোর্টে জানা যায়, অধিকাংশ নিহতের শরীরে জখমের চিহ্ন ছিল, যা ধারালো অস্ত্রের।

এই ভয়াল রাতে মোট ২০ জন জিম্মিকে হত্যা করে জঙ্গিরা। তাদের মধ্যে ৯ জন ইতালীয়, ৭ জন জাপানি, ১ জন ভারতীয়, ৩ জন বাংলাদেশি ছিলেন।

রাতভর আতঙ্কসকালবেলায় অভিযান

জঙ্গিরা রেস্তোরাঁ দখল করে রাখে পুরো রাত। মাঝে মাঝে সোশ্যাল মিডিয়ায় আইএস-এর পক্ষ থেকে ছবি প্রকাশ করা হয় ভেতরের। তারা আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে দাবি করে যে, এটি ‘ইসলামিক স্টেট’-এর হামলা। রাতভর আলোচনার পর ২ জুলাই ভোর ৭টার দিকে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ‘থান্ডারবোল্ট’ নামের বিশেষ অভিযান শুরু হয়।

মাত্র ১২ মিনিটের অভিযানে ৫ জন সন্ত্রাসী নিহত হয়, ১ জন ধরা পড়ে এবং রেস্তোরাঁর ভেতর থাকা ১৩ জন জিম্মিকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।

সন্দেহভাজন অতিথি: একজন রহস্যময় গ্রাহকের উপস্থিতি

সেদিনের রাতে রেস্তোরাঁয় থাকা অতিথিদের মধ্যে একজন রহস্যময় ব্যক্তি ছিলেন, যার নাম উঠে আসে পরবর্তীতে তদন্তে—তাহমিদ হাসিব খান, কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ টরন্টোর ছাত্র। প্রথমে তিনি সন্দেহের তালিকায় ছিলেন, কারণ ঘটনাস্থল থেকে তাকে জীবিত উদ্ধার করা হলেও তার বক্তব্য ছিল অসংলগ্ন। তাকে গ্রেপ্তারও করা হয়, পরে অবশ্য তদন্তে তার সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রমাণ মেলেনি এবং তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

জাতির ঘুম ভাঙানো রাত

হলি আর্টিজানের সেই রাতটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর জঙ্গি হামলার প্রতীক হয়ে আছে। এটি শুধু দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা নয়, বরং আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের প্রভাব, তরুণদের বিপথগামীতা, এবং ধর্মীয় চরমপন্থার ভয়ঙ্কর রূপ তুলে ধরেছে। অনেক পরিবার হারিয়েছে তাদের প্রিয়জন, আবার কেউ কেউ সারাজীবন বয়ে বেড়াবে সেই বিভীষিকার ক্ষত।

এই ঘটনায় প্রাণ হারানো মানুষদের স্মরণে আজো ওই জায়গায় নিরাপত্তা সিঁড়ি, স্মৃতিফলক, শান্ত পরিবেশ গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের ওই কালো রাত দেশের মননে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে।