এক নদীর এক জীবন: পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের পরিচয়
বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী ‘পুরাতন ব্রহ্মপুত্র’ একদিন ছিল ব্রহ্মপুত্রের মূল ধারা। দুই শতাব্দী আগে এই নদীর বুক চিরে গড়ে উঠেছিল শহর, পত্তন হয়েছিল ব্যবসা-বাণিজ্য, বসতি, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক জীবন। তবে আজ এই নদী যেন অতীতের মহিমা নিয়ে ক্ষীণধারায় প্রবাহমান এক স্মৃতি।
দুই শতাব্দীর প্রবাহ: ইতিহাস ও ভূগোল
১৮০০ সালের দিকে হিমালয়ের ‘চাংথাং’ মালভূমি থেকে উৎপত্তি হওয়া ব্রহ্মপুত্র নদ বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনায় মিলিত হতো। কিন্তু ১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে যমুনা হয়ে পশ্চিমে বাঁক নেয়। ফলে পুরাতন পথটি ‘পুরাতন ব্রহ্মপুত্র’ নামে পরিচিত হয়।
দুই পারে গড়ে ওঠা সভ্যতা
পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের দুই তীরজুড়ে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন জনপদ ও শহর। ময়মনসিংহ শহর, যা আজও জেলা সদর, একসময় এই নদীর তীরে দাঁড়িয়ে ছিল ব্যবসা, সংস্কৃতি ও শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে। জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, ভৈরব, গৌরীপুর, নান্দাইল—এই অঞ্চলগুলো ছিল নদীকেন্দ্রিক জনপদ। নদীর তীরবর্তী জমি ছিল উর্বর, কৃষি ও পাট চাষে সমৃদ্ধ।
ব্রিটিশ শাসনে বাণিজ্য ও যোগাযোগ
ব্রিটিশ আমলে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র ছিল রপ্তানি ও আমদানির অন্যতম জলপথ। ময়মনসিংহ থেকে পাট, চামড়া, চাল, কলা ও কাঠ নৌকাযোগে পাঠানো হতো নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা এবং কলকাতা পর্যন্ত। কলকাতার সঙ্গে এই নদীর মাধ্যমে যোগাযোগ ছিল অত্যন্ত সহজ। বড় বড় স্টিমার চলত এই নদীতে। গৌরীপুর, শম্ভুগঞ্জ, চন্দ্রদ্বীপ ছিল গুরুত্বপূর্ণ বন্দর।
পাকিস্তান আমলে অব্যাহত নদীকেন্দ্রিক অর্থনীতি
পাকিস্তান আমলে ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ ও জামালপুরের অর্থনীতি এ নদীনির্ভরই ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে পাট রপ্তানির জন্য পুরাতন ব্রহ্মপুত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। নদী দিয়ে রাজধানী ঢাকায় মালামাল যেত, সেখান থেকে করাচি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক বন্দরে পৌঁছাত।
স্বাধীন বাংলাদেশে নদীর অস্তিত্ব সংকট
স্বাধীনতার পর নাব্যতা হারাতে থাকে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র। পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দখল, বালু জমা ও অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণে নদী সংকুচিত হয়েছে। অথচ একসময় এই নদী শত শত মাইলজুড়ে ছিল জলপথের প্রধান সড়ক।
জলজ জীবন ও বন-জীববৈচিত্র্য
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র ছিল মাছের আধার। রুই, কাতলা, বোয়াল, আইড়, শোল, টেংরা, পাবদা ছিল প্রচুর। কিশোরগঞ্জের মিঠামইন বা নান্দাইলে এসব মাছ আজও ঐতিহ্যবাহী খাবার হিসেবে পরিচিত। নদীতীরবর্তী বনাঞ্চলে দেখা যেত কুমির, গুইসাপ ও নানা প্রজাতির জলচর পাখি; তবে এখন এসব প্রজাতি হুমকির মুখে।
দেশীয় শহর ও আন্তর্জাতিক সংযোগ
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র একসময় ভৈরব ও আশপাশের নদীবন্দরগুলোর মাধ্যমে ভারতের আসাম, কলকাতা এবং মিয়ানমার পর্যন্ত সংযোগ স্থাপন করেছিল। হস্তচালিত নৌকা থেকে শুরু করে স্টিমার, পরে কার্গো জাহাজও চলাচল করত এ নদীতে। ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জের বাজারে আসত বিদেশি পণ্য; একই সঙ্গে এখানকার পাট, চাল ও শুটকি যেত আন্তর্জাতিক বাজারে।
সাহিত্য ও সংগীতে নদীর প্রভাব
পুরাতন ব্রহ্মপুত্রকে ঘিরে রচিত হয়েছে বহু কবিতা, গান ও লোককাহিনি। ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’-র ‘মহুয়া’, ‘মলুয়া’ ও ‘চাঁদরানি’ কাহিনিতে নদীর প্রেক্ষাপট স্পষ্ট। নদীপাড়ে গড়ে উঠেছিল পালাগান, জারি-সারির আসর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম ময়মনসিংহ ভ্রমণে এসে নদীর রূপে মুগ্ধ হয়েছিলেন। ভাওয়াইয়া ও বাউল সংগীতেও পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের প্রশস্ততা ও জীবনদর্শন ধরা পড়েছে।
হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টা
বর্তমানে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় প্রশাসন নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে খনন প্রকল্পসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে। পাশাপাশি নদী পর্যটন, জলপথ পরিবহন, মাছচাষ ও সংস্কৃতি-ভিত্তিক প্রকল্প চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত পর্যটন নৌপথ চালুর বিষয়টি ভেবে দেখছে পর্যটন করপোরেশন।
একটি নদী শুধুই পানি নয়
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র কেবল একটি জলপথ নয়, এটি এক অব্যাহত প্রাণপ্রবাহ। এক সময় উত্তর–মধ্যাঞ্চলের অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি ও বাণিজ্যের প্রধান চালিকা শক্তি ছিল এ নদী। আজ তার বুকে পলিমাটি; তবু স্মৃতির ভাঁজে ছড়িয়ে আছে অগণিত ইতিহাস। সচেতন পরিকল্পনা ও কার্যকর সংরক্ষণ না হলে একদিন পুরাতন ব্রহ্মপুত্র কেবল বইয়ের পাতায়, গান আর কবিতার লাইনে বেঁচে থাকবে—বাস্তবে নয়।