প্রস্তাবনা
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে দীর্ঘদিনের প্রধান সমস্যা নিরাপদ মিঠাপানির ঘাটতি। লবণাক্ততা ক্রমে ভেতরে ঢুকে পড়া, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র প্রভাব এই সংকটকে আরো জটিল করেছে। এ বাস্তবতায় স্থানীয় প্রয়োজনে মানানসই, স্বল্পব্যয়ী ও টেকসই সমাধান খুঁজে বের করার লক্ষ্যে ব্র্যাক আন্তর্জাতিক পানি ও স্যানিটেশন কেন্দ্র (আইআরসি)-এর অংশীদারিত্বে এবং নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের আর্থিক সহায়তায় আয়োজন করে ‘ব্র্যাক-আইআরসি ওয়াটার হ্যাকাথন’।
হ্যাকাথনের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য
এই আয়োজনের মূল লক্ষ্য ছিল কমিউনিটি-কেন্দ্রিক নবীন ধারণা শনাক্ত করে পরীক্ষামূলকভাবে বাস্তবায়নের পথ খুলে দেওয়া, যাতে লবণাক্ততা-পীড়িত অঞ্চলের জন্য কার্যকর প্রযুক্তি ও সামাজিক প্রয়োগযোগ্য মডেল বাছাই করা যায়। তরুণ প্রকৌশলী, ডিজাইনার, সামাজিক উদ্যোক্তা ও প্রযুক্তিবিদদের অংশগ্রহণ দেখিয়েছে—জলবায়ু সহনশীল পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুন প্রজন্মের আগ্রহ দ্রুত বাড়ছে।
আবেদন ও বাছাই প্রক্রিয়া
হ্যাকাথনে ২৫০টিরও বেশি প্রস্তাব জমা পড়ে। বহুস্তরীয় মূল্যায়নের পর ১১টি দল ও ব্যক্তিকে চূড়ান্ত পর্বে বিচারকদের সামনে উপস্থাপনার সুযোগ দেওয়া হয়। এই কঠোর বাছাই প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে যে উপস্থাপিত ধারণাগুলো বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, স্থানীয়ভাবে অভিযোজ্য এবং সম্প্রসারণযোগ্য।
চূড়ান্ত পর্ব ও বিজয়ী উদ্যোগ
ঢাকার মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে ১৯ জুলাই ২০২৫ তারিখে অনুষ্ঠিত চূড়ান্ত পর্বে দুটি প্রকল্প প্রথম ও দ্বিতীয় পুরস্কার অর্জন করে।
প্রথম পুরস্কার: “প্রজেক্ট জলবন্ধু – একটি স্মার্ট কমিউনিটি-চালিত ওয়াটার গ্রিড; যেখানে অংশগ্রহণ, পয়েন্ট প্রণোদনা ও শক্তি ব্যবহারের সমন্বয়ে টেকসই সরবরাহ গড়ে তোলা” শীর্ষক উদ্যোগটি সাশ্রয়ী ব্যয়, স্থানীয় চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য, সম্প্রসারণের সম্ভাবনা ও বাস্তব প্রয়োগযোগ্যতার কারণে বিচারকদের সর্বোচ্চ প্রশংসা পায়।
দ্বিতীয় পুরস্কার: “অ্যাটমসফেরিক ময়েশ্চার ফর কোস্টাল কমিউনিটি” প্রকল্পটি (দল: মিফতাহুল জান্নাত লাবিবা, মো: জাহিদুল আলম ও ড. পার্থ দাস) উপকূলীয় পরিবেশে বায়ুমণ্ডলের আর্দ্রতা আহরণকে ব্যবহারিক পানির উৎসে রূপান্তরের নবীন দৃষ্টিভঙ্গির জন্য বিশেষভাবে নির্বাচিত হয়।
পরবর্তী পদক্ষেপ: পাইলট বাস্তবায়ন
আয়োজকদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, বিজয়ী ধারণাগুলো উপকূলীয় কয়েকটি নির্বাচিত এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হবে। এর মাধ্যমে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা, স্থানীয় সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে মানিয়ে নেওয়ার সামর্থ্য ও বৃহত্তর পরিসরে বিস্তার লাভের উপযোগিতা মূল্যায়ন করা হবে। পাইলট ফলাফল ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ ও নীতি সহায়তার রূপরেখা তৈরিতে সহায়ক হবে।
বিচারক প্যানেলের গঠন
বিচারক প্যানেলে ছিলেন:
· ড. শিবলী সাদিক – সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজার (ইন্টিগ্রেটেড ওয়াটার রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট), নেদারল্যান্ডস দূতাবাস, বাংলাদেশ
· এ.এইচ.এম খালেকুর রহমান – তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই)
· ড. সুফিয়া খানম – সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস)
· ড. তানভীর আহমেদ – অধ্যাপক, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
· আরিয়েন নাফস – ওয়াটার রিসোর্সেস অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ স্পেশালিস্ট, আইআরসি নেদারল্যান্ডস
· মো. জিল্লুর রহমান – হেড অব ইমপ্লিমেন্টেশন, ব্র্যাক ওয়াশ কর্মসূচি
· সারা আফরিন – হেড অব ব্র্যান্ড অ্যান্ড প্রোগ্রাম কমিউনিকেশন, ব্র্যাক
বিচারকদের অভিমত
ড. তানভীর আহমেদ মন্তব্য করেন যে হ্যাকাথন তরুণদের অমলিন ও মৌলিক ভাবনা বুঝে নেওয়ার এক শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে এবং এসব চিন্তার ভেতরে সুপ্ত ব্যাপক সম্ভাবনা নিহিত। এ.এইচ.এম খালেকুর রহমান বলেন, উপস্থাপিত ধারণাগুলো কেবল প্রযুক্তিনির্ভর ছিল না; এতে সামাজিক বাস্তবতা ও কমিউনিটির অংশগ্রহণও যুক্ত হয়েছে, যা একটি সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।
উদ্ভাবন ও সামাজিক প্রভাব
এই হ্যাকাথন দেখিয়েছে—প্রান্তিক উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা সৃষ্ট পানির সংকট ও জীবিকার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তরুণ উদ্ভাবনের ক্ষেত্র কতটা বিস্তৃত। পানি সংগ্রহ, পরিশোধন, বিতরণ, ব্যবস্থাপনা ও অংশগ্রহণভিত্তিক নজরদারিতে কমিউনিটি-চালিত ডিজিটাল ও স্বল্পব্যয়ী সমাধান সামনে আসায় ভবিষ্যতে জলবায়ু সহনশীল পরিকল্পনা প্রণয়নে নতুন দিক উন্মোচিত হবে।
জাতীয় ও বৈশ্বিক তাৎপর্য
আয়োজকদের প্রত্যাশা—এ ধরনের উদ্যোগ স্থানীয় জলবায়ু সহনশীল পানি ব্যবস্থাপনার চর্চাকে শক্তিশালী করবে এবং আন্তর্জাতিক সহায়তা, গবেষণা ও বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক হবে। স্থানীয়ভাবে পরীক্ষিত ও প্রমাণিত সমাধানই বৃহত্তর নীতি প্রণয়ন ও উন্নয়ন সহযোগিতার জন্য বিশ্বাসযোগ্য ভিত্তি গড়ে তোলে।
তরুণদের উদ্ভাবনী
উপকূলীয় পানির লবণাক্ততা সংকট টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)-এর পানি ও স্যানিটেশন, জলবায়ু সহনশীলতা, এবং দারিদ্র্য হ্রাসের লক্ষ্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। ‘ব্র্যাক-আইআরসি ওয়াটার হ্যাকাথন’ দেখিয়েছে—সমন্বিত অংশীদারিত্বের মাধ্যমে তরুণদের উদ্ভাবনী শক্তিকে প্রণোদিত করলে স্থানীয় সমস্যা সমাধানে বাস্তব পরিবর্তনের পথ তৈরি হয়। বিজয়ী উদ্যোগগুলোর পাইলট ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতে আরও বিস্তৃত বাস্তবায়ন ও নীতি সমর্থন গড়ে উঠবে—এ প্রত্যাশা এখন সংশ্লিষ্ট সকলের।