গন্ধগোকুল (Common Palm Civet), স্থানীয়ভাবে ‘গন্ধবিড়াল’, ‘খাটাশ’ বা ‘নেউল’ নামেও পরিচিত, একটি মাঝারি আকারের নিশাচর স্তন্যপায়ী প্রাণী। এদের দেহ দীর্ঘ ও সরু, গায়ে বাদামি–ধূসর পশম, দেহে ছাপযুক্ত দাগ এবং লেজে কালো-সাদা আড়াআড়ি ডোরা থাকে। এরা সাধারণত ফল, পোকামাকড়, ছোট পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণী খায় এবং গাছে চড়তে পারদর্শী।
গন্ধগোকুলের বিস্তৃতি ও আবাসস্থল
এক সময় গন্ধগোকুল বাংলাদেশজুড়ে বিস্তৃত ছিল। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, ময়মনসিংহ ও সুন্দরবন অঞ্চলে এর উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। গ্রামীণ ঝোপঝাড়, ফলের বাগান এবং বনাঞ্চল ছিল এর প্রাকৃতিক আবাসস্থল।
একশো বছর আগের চিত্র
১৯২০–৩০-এর দশকে বনভূমি ও গ্রামীণ এলাকাগুলোর প্রাকৃতিক ভারসাম্য ছিল তুলনামূলক বেশি। সেই সময় গ্রামবাংলার প্রায় প্রতিটি জেলায় এই প্রাণী দেখা যেত। গবেষণা বলছে, শতবর্ষ আগেও এদের সংখ্যা ছিল দশ হাজারের উপরে, বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে।
কমে যাওয়ার শুরু: বন উজাড় ও পরিবেশ বিপর্যয়
১৯৭০-এর দশক থেকে বাংলাদেশের বনভূমি ধ্বংস, গাছ কাটা, রাস্তা নির্মাণ এবং শহরায়নের ফলে গন্ধগোকুলের আবাসস্থল দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। এছাড়া মানুষের ভুল বিশ্বাস—যে এই প্রাণী হাঁস-মুরগি ধরে খায়—এর ফলে অনেক জায়গায় এদের মেরে ফেলা হতো। ১৯৮০–৯০-এর দশকে এসে এদের দেখা পাওয়া খুবই দুর্লভ হয়ে পড়ে।
বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে?
বর্তমানে বাংলাদেশে গন্ধগোকুল খুব সীমিতসংখ্যক এলাকায় টিকে আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এদের সংখ্যা এখন ২০০ থেকে ৩০০-এর মধ্যে, এবং তা মূলত পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের কিছু বনে এবং সুন্দরবনের কিছু অংশে সীমাবদ্ধ। ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহের গ্রামীণ এলাকা থেকেও প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
হুমকির কারণসমূহ
বন ধ্বংস ও শহরায়ন
খাদ্য সংকট ও বাসস্থানের অভাব
রোড-অ্যাকসিডেন্ট
শিকার ও হত্যার প্রবণতা
জনগণের মধ্যে সচেতনতার অভাব
রক্ষা ও সংরক্ষণে করণীয়
১. বন সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার: প্রাকৃতিক বনাঞ্চল রক্ষা করতে হবে এবং গন্ধগোকুলের আবাসস্থল পুনরায় তৈরি করতে হবে।
২. আইন প্রয়োগ: বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
৩. সচেতনতা বৃদ্ধি: গ্রামীণ জনগণের মধ্যে প্রচার করতে হবে যে এই প্রাণী ক্ষতিকর নয় এবং পরিবেশের জন্য উপকারী।
৪. অভয়ারণ্য ও পুনর্বাসন কেন্দ্র: বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে এই প্রাণীর জন্য অভয়ারণ্য ঘোষণা করা দরকার।
গন্ধগোকুল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের এক অনন্য প্রতিনিধি। এটি খাদ্য শৃঙ্খলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সহায়ক। যদি আমরা এখনই উদ্যোগ না নিই, তবে আগামী কয়েক দশকে এই প্রাণী শুধুই ছবি বা জাদুঘরের প্রদর্শনীর অংশ হয়ে থাকবে।