ক্যান্সার চিকিৎসায় দেশে এক কঠিন বাস্তবতা
বাংলাদেশে প্রতি বছর ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় দেড় লাখ নতুন ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হন, যার মধ্যে প্রায় ৯০ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। এই পরিসংখ্যান দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়। অথচ দেশে উন্নত মানের ক্যান্সার চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান অপ্রতুল এবং সেগুলোর মান নিয়েও রয়েছে বহু প্রশ্ন। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যেসব বাধা রয়েছে, তা বিশ্লেষণ করা জরুরি।
অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও জমি সংক্রান্ত জটিলতা
উন্নতমানের ক্যান্সার হাসপাতাল গঠনের জন্য প্রয়োজন নির্দিষ্ট মানদণ্ডের জায়গা, নির্মাণ ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত ও কার্যকরী যন্ত্রপাতি স্থাপনের সুযোগ। তবে বাংলাদেশে শহরাঞ্চলে জমির উচ্চমূল্য, জমি অধিগ্রহণে দুর্নীতি, প্রশাসনিক বিলম্ব এবং আইনি জটিলতার কারণে প্রস্তাবিত হাসপাতাল নির্মাণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বড় বাধা তৈরি হয়। রাজধানীর বাইরে অধিকাংশ স্থানে স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো পুরনো ও অনুন্নত, যা আধুনিক ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য উপযোগী নয়।
দক্ষ চিকিৎসক ও টেকনিক্যাল কর্মীর অভাব
ক্যান্সার চিকিৎসা অত্যন্ত বিশেষায়িত একটি ক্ষেত্র। এ ক্ষেত্রে মেডিকেল অনকোলজিস্ট, রেডিওথেরাপিস্ট, সার্জিক্যাল অনকোলজিস্ট, প্যালিয়েটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞসহ বহু দক্ষ পেশাজীবী দরকার হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের বিশেষজ্ঞের সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। বিএমডিসি ও বিএসএমএমইউ-এর প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দেশে অনকোলজিস্টের সংখ্যা ২০০-এরও কম, যা মোট চাহিদার তুলনায় অনেক কম। দেশের তরুণ চিকিৎসকরা অনকোলজি পড়তে আগ্রহী হলেও বিদেশে প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানকে প্রাধান্য দিয়ে দেশে ফিরছেন না, ফলে ব্রেইন ড্রেইন একটি বড় সমস্যা হয়ে উঠছে।
যন্ত্রপাতির স্বল্পতা ও রক্ষণাবেক্ষণের দুর্বলতা
আধুনিক ক্যান্সার চিকিৎসায় যেমন প্রয়োজন PET-CT স্ক্যান, লিনিয়ার এক্সিলারেটর (LINAC), রেডিওথেরাপি ইউনিট, তেমনই প্রয়োজন নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও দক্ষ অপারেটর। কিন্তু অধিকাংশ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি নেই, আর যেগুলো আছে সেগুলো প্রায়ই বিকল থাকে এবং মাসের পর মাস অচল অবস্থায় পড়ে থাকে। যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক কাঠামো জটিল ও ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান আধুনিক প্রযুক্তি আনার আগ্রহ হারায়।
চিকিৎসা ব্যয় ও আর্থিক অক্ষমতা
বাংলাদেশে ক্যান্সার চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বেসরকারি হাসপাতালে একটি কেমোথেরাপি সেশনের খরচ ২৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে, রেডিওথেরাপির খরচ আরও বেশি। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মধ্যবিত্ত তো বটেই, নিম্নবিত্তের পক্ষে চিকিৎসা নেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে কিছু সেবা থাকলেও সেখানে ভিড় ও অনিয়মের কারণে কার্যকর চিকিৎসা প্রাপ্তি কঠিন হয়ে পড়ে।
সমন্বয়হীন স্বাস্থ্যনীতি ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব
স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নে নানা উদ্যোগ থাকলেও বাস্তবায়নে রয়েছে ঘাটতি। ক্যান্সার প্রতিরোধ ও চিকিৎসা বিষয়ক একটি জাতীয় কৌশলগত নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও তার প্রয়োগ পর্যাপ্ত নয়। স্বাস্থ্য বাজেটে বরাদ্দ কম, এবং ক্যান্সার গবেষণা, প্রতিরোধ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বিশেষ কোনো তহবিল নিয়মিতভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয় না। উন্নত ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণের যে পরিকল্পনা রাজনৈতিকভাবে ঘোষিত হয়, তা দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে অথবা রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের অভাবে ঝুলে থাকে।
সামাজিক সচেতনতার ঘাটতি ও ভুল ধারণা
ক্যান্সার সম্পর্কে অনেক মানুষ এখনও ভয় ও কুসংস্কার পোষণ করে। প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা না নেওয়া, বিকল্প চিকিৎসার প্রতি নির্ভরতা, এবং হোমিওপ্যাথি বা কবিরাজি চিকিৎসার নামে প্রতারণার কারণে অনেক রোগী সময় হারিয়ে ফেলেন। ফলে ক্যান্সার ধরা পড়ে অনেক দেরিতে, যখন চিকিৎসা ব্যয়বহুল ও জটিল হয়ে যায়। এই পরিস্থিতি উন্নত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
সমাধানের পথ কোথায়?
বাংলাদেশে ক্যান্সার চিকিৎসায় আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল গড়ে তুলতে হলে একাধিক স্তরে পদক্ষেপ নিতে হবে—দক্ষ জনবল তৈরি, যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক ছাড়, গবেষণার জন্য বরাদ্দ বাড়ানো, স্বাস্থ্যসেবায় বাজেট বৃদ্ধির পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক দক্ষতা প্রয়োজন। একই সঙ্গে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য গণমাধ্যম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সমন্বয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রচার প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। নয়তো, ক্যান্সার চিকিৎসা নাগালের বাইরে থেকে যাবে দেশের লাখো মানুষের জন্য।