এক বিষাক্ত আতঙ্ক: ম্যালেরিয়া ও পার্বত্য বাস্তবতা
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে এক ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি—ম্যালেরিয়া। বিশেষ করে রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় এই রোগ এখনো এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে। আবহাওয়াগত বৈশিষ্ট্য, বনভূমি, এবং মশার বংশবিস্তারের জন্য উপযোগী পরিবেশ ম্যালেরিয়ার বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে চলেছে।
পরিসংখ্যান বলছে যা
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের সব জেলায় ম্যালেরিয়া পুরোপুরি নির্মূল হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু উপজেলায় এখনো এটি স্থানীয়ভাবে সংক্রামক অবস্থায় রয়েছে। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হন, যার মধ্যে বেশিরভাগই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর। বিশেষ করে বর্ষাকালে এই সংখ্যা দ্রুত বাড়ে।
পাহাড়ি পরিবেশে সংক্রমণের উৎস
পার্বত্য চট্টগ্রামে ম্যালেরিয়া প্রধানত অ্যানোফেলিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এখানকার গভীর বন, পাহাড়ি ছড়া ও জলাশয় এই মশার আবাসস্থল। মানুষ যখন রাতে ঝুপড়ি বা খোলা জায়গায় ঘুমায়, তখন তারা বেশি আক্রান্ত হয়। তাছাড়া, শ্রমিকেরা যখন গভীর জঙ্গলে জুমচাষে যায়, তখনও তাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়।
স্বাস্থ্যসেবার সীমাবদ্ধতা
এলাকাগুলো অনেকাংশে দুর্গম হওয়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছাতে সময় লাগে। অনেক গ্রামে এখনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই, বা থাকলেও পর্যাপ্ত ওষুধ ও প্রশিক্ষিত কর্মীর অভাব রয়েছে। ফলে রোগী শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা অনেক সময়েই দেরিতে হয়, যা রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।
প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ ও সফলতা
সরকার ও কিছু বেসরকারি সংস্থা সম্মিলিতভাবে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে কাজ করছে। কীটনাশকযুক্ত মশারির বিতরণ, ঘর পরিস্কার রাখা, স্থানীয় লোকদের সচেতনতা বৃদ্ধি, ও দ্রুত পরীক্ষার ব্যবস্থা কিছুটা সফলতা এনেছে। ২০০৮ সালের তুলনায় এখন আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৮০% হ্রাস পেয়েছে। তবে পুরোপুরি নির্মূলের জন্য আরও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার।
স্থানীয়দের ভূমিকা ও চ্যালেঞ্জ
স্থানীয় জনগণ এখনও অনেকাংশে ম্যালেরিয়া সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করে। অনেকে মনে করে এটি ঠাণ্ডা-জ্বরের মতো সাধারণ রোগ। ফলে তারা চিকিৎসা না নিয়ে ঘরোয়া উপায়ে নিরাময় করতে চেষ্টা করে, যা মারাত্মক হতে পারে। এদের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে আরও বেশি প্রচার, প্রশিক্ষণ ও বিদ্যালয়ভিত্তিক কর্মসূচি প্রয়োজন।
: সুস্থ পাহাড় চাই
পার্বত্য চট্টগ্রামে ম্যালেরিয়া এক নীরব ঘাতক। প্রকৃতি যেমন সুন্দর, তেমনি তা রোগের বিস্তারের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। তাই উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, সচেতনতা বৃদ্ধি, স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ এবং কার্যকর সরকারি উদ্যোগ একসাথে বাস্তবায়ন করতে পারলেই কেবল এই রোগকে সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব। পাহাড়ের মানুষ deserves a malaria-free future—একটি সুস্থ, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন।