যানজটের শহরে প্রতিদিনই এক নতুন যুদ্ধ
ঢাকা শহর যেন প্রতিদিন এক অদৃশ্য যুদ্ধে লিপ্ত—এ যুদ্ধ সময়ের বিরুদ্ধে, ধৈর্যের বিরুদ্ধে, জীবনের স্বাভাবিকতার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের রাজধানী ও প্রশাসনিক কেন্দ্র হলেও ঢাকার রাস্তাগুলো যেন প্রতিনিয়ত মানুষের কষ্ট, হতাশা ও অক্ষমতার প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অফিস টাইম, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, বিয়ে, মৃত্যু—এমনকি একটি সাধারণ ঘর থেকে বের হওয়ার মুহূর্তেও মানুষকে অজানা এক দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়তে হয়—“জ্যামে পড়ব না তো?”
প্রতিদিনের যানজট শুধু অসুবিধা নয়, অনেক সময় তা হয়ে ওঠে জীবন-মরণ, সম্পর্ক বিচ্ছেদ কিংবা অভূতপূর্ব, নাটকীয় ঘটনার সূচনা। রাজধানীর জ্যামের ভেতরে লুকিয়ে আছে এমন কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনা, যেগুলো শুনলে মনে হবে এগুলো কোনো সিনেমার দৃশ্য, কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে এই শহরের বুকে। এই প্রতিবেদন তুলে ধরছে ঢাকার ট্রাফিক জ্যামের কারণে ঘটেছে এমন কিছু অস্বাভাবিক ও বিস্ময়কর ঘটনা, যা নাগরিক জীবনের বেদনা ও বাস্তবতাকে আরও গভীরভাবে স্পর্শ করে।
শহরের সীমানায় আটকে পড়া মৃত্যু
২০১৯ সালের এক শীতের সকালে মুগদা জেনারেল হাসপাতাল থেকে এক ক্যান্সার রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে করে গাজীপুরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা ছিল। রোগীর শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানো অত্যন্ত জরুরি ছিল। কিন্তু মহাখালী, ফার্মগেট ও তেজগাঁও এলাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থেকে রোগীর অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। চার ঘণ্টার ব্যবধানে রোগীটি অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যেই মারা যান। পরে পুলিশ এসে রাস্তায় সহায়তা করলেও এত দেরি হয়ে যায় যে কোনো চিকিৎসা কার্যকর হয়নি।
বরের কনেকে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিয়ে ভেঙে যায়
২০২২ সালের ডিসেম্বরে মোহাম্মদপুর থেকে মিরপুরে বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে বর ও তার আত্মীয়-স্বজনদের বহনকারী গাড়ি আটকে পড়ে গাবতলীর জ্যামে। নির্ধারিত সময়ে বর না পৌঁছানোয় কনের পরিবার ক্ষুব্ধ হয়ে বিয়ে বাতিল করে। অনুষ্ঠানস্থলে অতিথিরা অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে চলে যান। শেষে বর যখন পৌঁছালেন, তখন কেউই অপেক্ষায় ছিলেন না। সামান্য যানজটের জন্য এক সম্পর্ক ভেঙে যায় চিরতরে।
পরীক্ষার হলে পৌঁছাতে না পেরে আত্মহত্যা
এক তরুণ শিক্ষার্থী, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে যাচ্ছিলেন, বনানী থেকে রওনা হয়ে শাহবাগ পর্যন্ত দীর্ঘ দেড় ঘণ্টার ট্রাফিক জ্যামে আটকে পড়েন। পরীক্ষার কেন্দ্রে পৌঁছাতে ১০ মিনিট দেরি হওয়ায় তাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। নিজের স্বপ্নের এমন পরিণতি মেনে নিতে না পেরে ওই দিন সন্ধ্যায় সে আত্মহত্যা করে। তার পরিবার পরে সংবাদমাধ্যমে বলে, “ছেলেটা মারা যায়নি, তাকে শহরের জ্যাম মেরেছে।”
ট্রাফিক জ্যামে সন্তান প্রসব
২০২৪ সালের মার্চে এক গর্ভবতী নারী ধানমণ্ডি থেকে বারডেম হাসপাতালে যাওয়ার পথে রাশেল স্কয়ারে আটকে যান। ট্রাফিক এতটাই স্থবির ছিল যে সেখানেই তার প্রসব ব্যথা শুরু হয় এবং অবশেষে গাড়ির ভেতরেই নবজাতকের জন্ম হয়। পথচারীরা কাপড়, পানি ও মানসিক সহায়তা দিয়ে পাশে দাঁড়ায়। হাসপাতালে পৌঁছাতে অ্যাম্বুলেন্স ডাকলেও তা পৌঁছাতে সময় নেয় ৪০ মিনিট। মা ও সন্তান সুস্থ থাকলেও এই ঘটনা ছিল এক আতঙ্কজনক স্মৃতি।
লাশবাহী গাড়ি আটকে, জানাজা পেছালো
২০২৩ সালের আগস্টে নারায়ণগঞ্জ থেকে বনানী কবরস্থানে এক মৃত ব্যক্তির লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কিন্তু সকাল ৯টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত গাড়িটি মালিবাগ, মগবাজার ও মতিঝিল এলাকায় একটানা যানজটে আটকে থাকে। নির্ধারিত সময়ে জানাজা না হওয়ায় দাফন পেছাতে বাধ্য হয় পরিবারটি। ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনাটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং প্রশ্ন তোলে, নগর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বহীনতা নিয়ে।
মন্ত্রী হেঁটে সভাস্থলে পৌঁছালেন
২০২৩ সালের একটি ঘটনার সময় মতিঝিলে একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে অংশ নিতে যাচ্ছিলেন একজন মন্ত্রী। শাহবাগ থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মাত্র ২০ মিনিটের পথ গাড়িতে দেড় ঘণ্টা ধরে আটকে থাকার পর তিনি নিজেই গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করেন। সামাজিক মাধ্যমে তার হাঁটার ছবি ছড়িয়ে পড়ে এবং জনগণের মধ্যে প্রশ্ন ওঠে—যদি মন্ত্রীকেও জ্যাম ঠেকাতে পারে না, তাহলে সাধারণ মানুষের কী অবস্থা?
অস্বাভাবিকতাই ঢাকার স্বাভাবিকতা
ঢাকার যানজট এখন কেবল একটি নগর পরিকল্পনার ব্যর্থতা নয়, এটি একটি সামাজিক, মানবিক এবং সাংস্কৃতিক সংকটে রূপ নিয়েছে। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ শুধু অফিসে পৌঁছাতে নয়, জীবনের নানা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে শহরের রাস্তায় আটকে পড়ে নিজের ভবিষ্যৎ, সম্পর্ক কিংবা স্বপ্ন হারাচ্ছেন। প্রতিটিই যেন একেকটি ট্র্যাজেডির সূচনা। এসব অদ্ভুত ঘটনাই প্রমাণ করে যে, ঢাকায় এখন অস্বাভাবিকতাই যেন নতুন স্বাভাবিকতা।