০৮:৫২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০২ অগাস্ট ২০২৫

মুহাম্মদ রফি: উপমহাদেশের গানের এক রাজা ও  তাঁর বাংলায় পদচারণা

এক গানের সাধকের জন্ম

ভারতের সঙ্গীত ইতিহাসে যে ক’জন শিল্পীর নাম সোনার অক্ষরে লেখা হয়, তাদের একজন হলেন মুহাম্মদ রফি। তাঁর কণ্ঠে যেমন ছিল মাধুর্য, তেমনি ছিল বিস্তৃত রেঞ্জ, যেটি তাঁকে ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। হিন্দি সিনেমার পাশাপাশি পাঞ্জাবি, মারাঠি, কন্নড়, গুজরাটি, তেলেগু, অসমিয়া, ওড়িয়া এবং বাংলা ভাষাতেও গান করেছেন এই কিংবদন্তি। বাংলা ভাষার গানগুলো সংখ্যায় তুলনামূলকভাবে কম হলেও প্রতিটি গানে রফি রেখে গেছেন অসামান্য আবেগ ও সুরের ছাপ।

শৈশব ও সংগীতের প্রতি আগ্রহ

মুহাম্মদ রফির জন্ম ১৯২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর, পাঞ্জাবের কোটলা সুলতান সিং গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই গান শুনে শুনে বড় হওয়া — বিশেষ করে তিনি মগ্ন থাকতেন এক বাউল সন্ন্যাসীর গান শুনতে, যিনি পাড়া-মহল্লায় ঘুরে গান করতেন। রফির ভাইয়ের চায়ের দোকানে বসে গান গাওয়া থেকে শুরু করে লাহোর রেডিওতে গান গাওয়া পর্যন্ত ছিল তাঁর সংগীত জীবনের প্রথম ধাপ।

Mohammed Rafi made his Hindi film debut in Gaon Ki Gori in 1945. | Kavishala Daily

বলিউডে পথচলা ও উত্থান

১৯৪৪ সালে মুম্বাই (তৎকালীন বোম্বে) যাত্রা করেছিলেন তিনি। প্রথম হিন্দি ছবি ‘গাঁও কি গোরি’-তে গান গাওয়ার মাধ্যমে বলিউডে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর তিনি গেয়েছেন লক্ষাধিক গান—প্রেম, বিরহ, দেশপ্রেম, কৌতুক, ভক্তি—প্রতিটি ঘরানাতেই তিনি ছিলেন সমান দক্ষ।

তাঁর জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে—“চাহুংগা ম্যায় তুঝে সাঁঝ সাভেরে”, “বাহারো ফুল বারসাও”, “আজ পুরানি রাহো পে”, “ইয়ে রেশমি জুলফে” প্রভৃতি। রফি ছিলেন সেই বিরল শিল্পী যিনি দিলীপ কুমার, দেব আনন্দ, রাজেন্দ্র কুমার, শাম্মী কাপুর, জয়ন্ত, রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন—সবার কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন।

বাংলা গানে মুহাম্মদ রফি: সীমিত কিন্তু অম্লান

মুহাম্মদ রফি বাংলায় গান গেয়েছেন মূলত ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে। তাঁর কণ্ঠে যেসব বাংলা গান রেকর্ড হয়েছে, সেগুলো বাংলা চলচ্চিত্র ও রেডিওর মাধ্যমে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছেছে। তাঁর বাংলা গানগুলো গুণগত মানে সমান উচ্চতায় ছিল, যদিও সংখ্যায় তুলনামূলকভাবে কম।

Remembering the legend Mohammed Rafi, 7 best songs of his career - The Statesman

উল্লেখযোগ্য বাংলা গান:

১. এক পরদেশি মেঘ এসেছে” — চলচ্চিত্র: নীল আকাশের নীচে
সুর: হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
একটি চিরন্তন মনমুগ্ধকর গান, যেটিতে রফির গলায় বিষণ্ণতা আর দরদ গভীরভাবে প্রকাশিত হয়েছে।

২. প্রেমের জ্যোতিতে জীবন গড়েছি” — স্বাধীন রেকর্ড রিলিজ
সুরকার: স্বপন চক্রবর্তী
একান্ত প্রেমের আকুতি নিয়ে গাওয়া গান, যেখানে রফির উচ্চারণে ছিল স্বচ্ছ বাংলা ভাষার চমৎকারতা।

৩. ভালোবাসা তরঙ্গে তরঙ্গে”
বেসরকারি রেকর্ড রিলিজ
রোমান্টিক ঘরানার এই গানটি গ্রামোফোন রেকর্ডের মাধ্যমে রিলিজ হয়েছিল। আজও সঙ্গীতপ্রেমীরা এই গান খোঁজ করেন।

৪. চলো বন্ধু, চলো নদী তীরে”
লঘু ধারা ও বাংলার প্রকৃতি নিয়ে লেখা গান, যেখানে রফির কণ্ঠ পল্লিগীতির আবহ এনে দিয়েছে।

The Best Mohammed Rafi Songs You've Never Heard Of | IWMBuzz

বাংলা উচ্চারণে রফির দক্ষতা

যদিও রফির মাতৃভাষা ছিল উর্দু ও পাঞ্জাবি, তবে বাংলা গান গাওয়ার সময় তিনি উচ্চারণের দিকে অসাধারণ যত্ন নিয়েছেন। বিশেষ করে ‘চ’, ‘ট’, ‘ণ’, ‘ড়’ — এসব ব্যঞ্জনের ব্যবহারে তিনি যথার্থ সাবলীলতা বজায় রেখেছেন, যা বাংলা ভাষাভাষী শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছে।

রফির প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন ছিল অত্যন্ত কঠোর। তিনি যেকোনো ভাষায় গান গাওয়ার আগে উচ্চারণ শেখার জন্য স্থানীয় গাইড নিয়োগ করতেন।

ব্যক্তিজীবন ও সরলতা

রফি ছিলেন অত্যন্ত ধর্মভীরু, নিরহঙ্কার ও শান্ত স্বভাবের মানুষ। নিজের দানশীলতার জন্যও তিনি ছিলেন প্রখ্যাত—শোনা যায়, অসচ্ছল গীতিকার বা সুরকারদের বিনা পারিশ্রমিকে গান গেয়ে দিতেন তিনি। এমনকি নিজের নাম ছাড়াও একাধিক সিনেমায় গান গেয়েছেন কেবল গায়ক ও সুরকারদের ভালবাসার কারণে।

Mohammed Rafi Biography for Students and Children – Kids Portal For Parents

মৃত্যু ও উত্তরাধিকার

১৯৮০ সালের ৩১ জুলাই মাত্র ৫৫ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মুহাম্মদ রফির মৃত্যু হয়। তাঁর জানাজায় লাখো মানুষ অংশ নেয়, যা প্রমাণ করে তিনি কেবল এক শিল্পী ছিলেন না, ছিলেন মানুষের আত্মার সঙ্গী।

বর্তমানে তাঁর গান বিশ্বজুড়ে নানা প্রজন্মের মানুষ শুনছে—ইউটিউব, রেডিও কিংবা চলচ্চিত্রের স্মরণসভায়। তাঁর বাংলা গানগুলোও রিমাস্টার হয়ে আবার শ্রোতাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে, নতুনভাবে।

 বাংলার মাটি ছুঁয়ে যাওয়া রফির সুর

যদিও বাংলা গান রফির বৃহৎ কর্মজীবনের সামান্য অংশ, তবুও তা সঙ্গীত ইতিহাসে আলাদা জায়গা করে নিয়েছে। বাংলা ভাষায় তাঁর কণ্ঠ আজও শুনলেই বোঝা যায়, ভালোবাসা, আবেগ আর শুদ্ধতা কিভাবে একজন শিল্পীর কণ্ঠে জড়িয়ে থাকে।

মুহাম্মদ রফি কেবল একটি নাম নয়—তিনি একটি সুরের যুগ, একটি আবেগ, একটি স্নিগ্ধতার স্রোত। বাংলা গানেও তাঁর ছোঁয়া আজও অমলিন।

জনপ্রিয় সংবাদ

মুহাম্মদ রফি: উপমহাদেশের গানের এক রাজা ও  তাঁর বাংলায় পদচারণা

০৬:৩৫:২১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১ অগাস্ট ২০২৫

এক গানের সাধকের জন্ম

ভারতের সঙ্গীত ইতিহাসে যে ক’জন শিল্পীর নাম সোনার অক্ষরে লেখা হয়, তাদের একজন হলেন মুহাম্মদ রফি। তাঁর কণ্ঠে যেমন ছিল মাধুর্য, তেমনি ছিল বিস্তৃত রেঞ্জ, যেটি তাঁকে ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। হিন্দি সিনেমার পাশাপাশি পাঞ্জাবি, মারাঠি, কন্নড়, গুজরাটি, তেলেগু, অসমিয়া, ওড়িয়া এবং বাংলা ভাষাতেও গান করেছেন এই কিংবদন্তি। বাংলা ভাষার গানগুলো সংখ্যায় তুলনামূলকভাবে কম হলেও প্রতিটি গানে রফি রেখে গেছেন অসামান্য আবেগ ও সুরের ছাপ।

শৈশব ও সংগীতের প্রতি আগ্রহ

মুহাম্মদ রফির জন্ম ১৯২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর, পাঞ্জাবের কোটলা সুলতান সিং গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই গান শুনে শুনে বড় হওয়া — বিশেষ করে তিনি মগ্ন থাকতেন এক বাউল সন্ন্যাসীর গান শুনতে, যিনি পাড়া-মহল্লায় ঘুরে গান করতেন। রফির ভাইয়ের চায়ের দোকানে বসে গান গাওয়া থেকে শুরু করে লাহোর রেডিওতে গান গাওয়া পর্যন্ত ছিল তাঁর সংগীত জীবনের প্রথম ধাপ।

Mohammed Rafi made his Hindi film debut in Gaon Ki Gori in 1945. | Kavishala Daily

বলিউডে পথচলা ও উত্থান

১৯৪৪ সালে মুম্বাই (তৎকালীন বোম্বে) যাত্রা করেছিলেন তিনি। প্রথম হিন্দি ছবি ‘গাঁও কি গোরি’-তে গান গাওয়ার মাধ্যমে বলিউডে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর তিনি গেয়েছেন লক্ষাধিক গান—প্রেম, বিরহ, দেশপ্রেম, কৌতুক, ভক্তি—প্রতিটি ঘরানাতেই তিনি ছিলেন সমান দক্ষ।

তাঁর জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে—“চাহুংগা ম্যায় তুঝে সাঁঝ সাভেরে”, “বাহারো ফুল বারসাও”, “আজ পুরানি রাহো পে”, “ইয়ে রেশমি জুলফে” প্রভৃতি। রফি ছিলেন সেই বিরল শিল্পী যিনি দিলীপ কুমার, দেব আনন্দ, রাজেন্দ্র কুমার, শাম্মী কাপুর, জয়ন্ত, রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন—সবার কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন।

বাংলা গানে মুহাম্মদ রফি: সীমিত কিন্তু অম্লান

মুহাম্মদ রফি বাংলায় গান গেয়েছেন মূলত ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে। তাঁর কণ্ঠে যেসব বাংলা গান রেকর্ড হয়েছে, সেগুলো বাংলা চলচ্চিত্র ও রেডিওর মাধ্যমে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছেছে। তাঁর বাংলা গানগুলো গুণগত মানে সমান উচ্চতায় ছিল, যদিও সংখ্যায় তুলনামূলকভাবে কম।

Remembering the legend Mohammed Rafi, 7 best songs of his career - The Statesman

উল্লেখযোগ্য বাংলা গান:

১. এক পরদেশি মেঘ এসেছে” — চলচ্চিত্র: নীল আকাশের নীচে
সুর: হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
একটি চিরন্তন মনমুগ্ধকর গান, যেটিতে রফির গলায় বিষণ্ণতা আর দরদ গভীরভাবে প্রকাশিত হয়েছে।

২. প্রেমের জ্যোতিতে জীবন গড়েছি” — স্বাধীন রেকর্ড রিলিজ
সুরকার: স্বপন চক্রবর্তী
একান্ত প্রেমের আকুতি নিয়ে গাওয়া গান, যেখানে রফির উচ্চারণে ছিল স্বচ্ছ বাংলা ভাষার চমৎকারতা।

৩. ভালোবাসা তরঙ্গে তরঙ্গে”
বেসরকারি রেকর্ড রিলিজ
রোমান্টিক ঘরানার এই গানটি গ্রামোফোন রেকর্ডের মাধ্যমে রিলিজ হয়েছিল। আজও সঙ্গীতপ্রেমীরা এই গান খোঁজ করেন।

৪. চলো বন্ধু, চলো নদী তীরে”
লঘু ধারা ও বাংলার প্রকৃতি নিয়ে লেখা গান, যেখানে রফির কণ্ঠ পল্লিগীতির আবহ এনে দিয়েছে।

The Best Mohammed Rafi Songs You've Never Heard Of | IWMBuzz

বাংলা উচ্চারণে রফির দক্ষতা

যদিও রফির মাতৃভাষা ছিল উর্দু ও পাঞ্জাবি, তবে বাংলা গান গাওয়ার সময় তিনি উচ্চারণের দিকে অসাধারণ যত্ন নিয়েছেন। বিশেষ করে ‘চ’, ‘ট’, ‘ণ’, ‘ড়’ — এসব ব্যঞ্জনের ব্যবহারে তিনি যথার্থ সাবলীলতা বজায় রেখেছেন, যা বাংলা ভাষাভাষী শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছে।

রফির প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন ছিল অত্যন্ত কঠোর। তিনি যেকোনো ভাষায় গান গাওয়ার আগে উচ্চারণ শেখার জন্য স্থানীয় গাইড নিয়োগ করতেন।

ব্যক্তিজীবন ও সরলতা

রফি ছিলেন অত্যন্ত ধর্মভীরু, নিরহঙ্কার ও শান্ত স্বভাবের মানুষ। নিজের দানশীলতার জন্যও তিনি ছিলেন প্রখ্যাত—শোনা যায়, অসচ্ছল গীতিকার বা সুরকারদের বিনা পারিশ্রমিকে গান গেয়ে দিতেন তিনি। এমনকি নিজের নাম ছাড়াও একাধিক সিনেমায় গান গেয়েছেন কেবল গায়ক ও সুরকারদের ভালবাসার কারণে।

Mohammed Rafi Biography for Students and Children – Kids Portal For Parents

মৃত্যু ও উত্তরাধিকার

১৯৮০ সালের ৩১ জুলাই মাত্র ৫৫ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মুহাম্মদ রফির মৃত্যু হয়। তাঁর জানাজায় লাখো মানুষ অংশ নেয়, যা প্রমাণ করে তিনি কেবল এক শিল্পী ছিলেন না, ছিলেন মানুষের আত্মার সঙ্গী।

বর্তমানে তাঁর গান বিশ্বজুড়ে নানা প্রজন্মের মানুষ শুনছে—ইউটিউব, রেডিও কিংবা চলচ্চিত্রের স্মরণসভায়। তাঁর বাংলা গানগুলোও রিমাস্টার হয়ে আবার শ্রোতাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে, নতুনভাবে।

 বাংলার মাটি ছুঁয়ে যাওয়া রফির সুর

যদিও বাংলা গান রফির বৃহৎ কর্মজীবনের সামান্য অংশ, তবুও তা সঙ্গীত ইতিহাসে আলাদা জায়গা করে নিয়েছে। বাংলা ভাষায় তাঁর কণ্ঠ আজও শুনলেই বোঝা যায়, ভালোবাসা, আবেগ আর শুদ্ধতা কিভাবে একজন শিল্পীর কণ্ঠে জড়িয়ে থাকে।

মুহাম্মদ রফি কেবল একটি নাম নয়—তিনি একটি সুরের যুগ, একটি আবেগ, একটি স্নিগ্ধতার স্রোত। বাংলা গানেও তাঁর ছোঁয়া আজও অমলিন।