প্রকৃতিতে “মা” শব্দটির আলাদা কোনো সংজ্ঞার প্রয়োজন নেই। “মা” শব্দটি উচ্চারণের সময় “ম” ধ্বনি তৈরি হয়, যা পৃথিবীর প্রায় সব ভাষায় মা, আম্মা ইত্যাদি রূপে বিদ্যমান। এমনকি প্রাণীদের ডাকেও মায়ের প্রতি আহ্বানে “ম” ধ্বনির প্রভাব দেখা যায়। প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো এই “মা” সত্তা। সম্ভবত এ কারণেই এই শব্দগুলোর মধ্যে মিল আছে। এই ছবিতে দুই মাকে দেখা যাচ্ছে—প্রকৃতি মা এবং জঙ্গলে বাস করা বিড়ালের মা—যারা হাতে হাত রেখে সন্তানের সুরক্ষায় রয়েছেন। মাতৃত্বের সেই সর্বজনীন অনুভূতি ভাষা, প্রজাতি ও সীমান্ত ছাড়িয়ে ওঠে।
বিশ্বজুড়ে ম্যানগ্রোভ বনভূমির গুরুত্ব ও সৌন্দর্যের প্রতিফলন ধরে ধরে নিয়ে ১১তম ম্যানগ্রোভ ফটোগ্রাফি অ্যাওয়ার্ডস এই বছর ম্যানগ্রোভ অ্যাকশন প্রজেক্টের উদ্যোগে আয়োজন করা হয়। ৭৮টি দেশ থেকে প্রতিযোগিতায় ৩,৩০৩টি ছবি জমা পড়ে। বন্যপ্রাণী, প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং মানুষ—এই তিনটি প্রধান বিভাগের প্রতিটি ক্ষেত্রেই মনোমুগ্ধকর ছবি এসে পৌঁছেছে। বিচারকমণ্ডলীতে ছিলেন বিশ্বখ্যাত আলোকচিত্রী ও বিশেষজ্ঞরা, যার মধ্যে ছিলেন থাই ফটোসাংবাদিক ও সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী সিরাচাই ‘শিন’ আরুনরুগস্টিচাই, পুরস্কারজয়ী বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী চিয়েন লি, এবং পানির নিচের ফটোগ্রাফার, ভিডিওগ্রাফার ও হাঙর বিশেষজ্ঞ টানিয়া হুপারম্যানস। নিচে প্রতিটি বিভাগের নির্বাচিত কয়েকটি বিজয়ী ছবির বর্ণনা দেওয়া হলো।

ম্যানগ্রোভে ব্ল্যাকটিপ রিফ হাঙর – কিলি ইউইয়ান
পালাউয়ের রক আইল্যান্ডসের সাউদার্ন লেগুনের অগভীর জলে এক আল্পবয়স্ক ব্ল্যাকটিপ রিফ হাঙর সাঁতার কাটছে। স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ীরা প্রায়ই অবশিষ্ট খাবার পানিতে ফেলে দেয়, ফলে হাঙরগুলো কাছে আসে এবং পর্যটকরা সহজে তাদের দেখতে পারে। পালাউ ছিল পৃথিবীর প্রথম দেশ যা নিজেকে ‘হাঙর অভয়ারণ্য’ ঘোষণা করেছিল।

নেটস – সনীত কুমার গৌড় কন্দুরি
পেছনে জেলে, সামনে মাছ—এই ছবিটির শিরোনাম “জেলে আর মাছ”। সরল কম্পোজিশনে মানুষের সূক্ষ্ম সম্পর্ক ও জীবিকা, পাশাপাশি সামুদ্রিক উৎসবের ছোঁয়া ফুটে উঠেছে।

ম্যানগ্রোভ বনে এক নাসিকা বানরের নাস্তা – সাতউইকা সাতরিয়া
এক অল্পবয়স্ক নাসিকা বানর ঘন ম্যানগ্রোভ বনের মধ্যেই অ্যাভিসেন্নিয়া ফল খাচ্ছে, যা নাসিকা বানরের প্রধান খাদ্যের একটি। ছবিটি বিপন্ন এই প্রাণীর টিকে থাকার ক্ষেত্রে ম্যানগ্রোভ বাস্তুতন্ত্রের অপরিহার্য ভূমিকা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে।
পাতালের প্রহরী – রদলফ গুইনার্ড
মায়া সংস্কৃতিতে কুমিরকে পবিত্র প্রাণী হিসেবে ধরা হয়, যিনি পৃথিবী, আকাশ ও পানিকে একত্রিত করেন। মায়াদের বিশ্বাস অনুযায়ী, কুমির প্রকৃতি এবং পাতাল—এই দুই জগতের সঙ্গেই যুক্ত। ইউকাটান অঞ্চলের মায়াদের কাছে ‘সেনোট’ হলো পাতালের দরজা। পুরাণে বলা হয়, কুমির জীবিত ও মৃতের জগতের সীমান্তে ভেসে থাকে। সেনোটে ভাসমান সেই কুমিরের ছবি প্রাচীন কিংবদন্তিকে জীবন্ত করে তুলেছে।

ফাটা মাটি – মোহাম্মদ আমদাদ হোসেন
খুলনার শ্যামনগরে খরায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তরে এক নারী ও তার নাতি শেষ অবশিষ্ট পানির উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করছেন। নদীর কাছেই বাস করলেও লবণাক্ততার কারণে প্রতিদিন ২-৩ কিলোমিটার হাঁটতে হয় পানযোগ্য পানি পেতে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং কম বৃষ্টিপাতের ফলে এই অবস্থা তৈরি হয়েছে, যা উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ সম্প্রদায়ের জন্য একটি ভয়াবহ সংকট।
মায়ের সুরক্ষা – সাত্যকি নাহা
প্রকৃতি মা ও জঙ্গলের বিড়ালের মা—দুই মায়ের একসঙ্গে সন্তানের সুরক্ষার দৃশ্যটি এই ছবিতে ফুটে উঠেছে। মাতৃত্বের অনুভূতি ভাষা, প্রজাতি ও সীমান্ত ছাড়িয়ে সর্বজনীন হয়ে দাঁড়ায়।

সমন্বিত উড়ান – শ্যাজিথ ওনদেন চেরিয়াথ
সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল জোরা ম্যানগ্রোভ রিজার্ভের শান্ত জলাভূমিতে ভোরের আলোয় তোলা আকাশচিত্রে একদল ফ্লেমিঙ্গোকে অগভীর পানিতে সুশৃঙ্খলভাবে হাঁটতে দেখা যাচ্ছে। ম্যানগ্রোভ ও আকাশের নীল প্রতিবিম্বে সৃষ্টি হয়েছে মনোমুগ্ধকর বৈপরীত্য, যা নগরায়ণ ও নাজুক বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে ভারসাম্যকে ফুটিয়ে তোলে। ছবিটি আমিরাতের গুরুত্বপূর্ণ ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণের প্রচেষ্টার অংশ।

পাখিদের ইমপ্রেশনিজম – মার্ক ইয়ান কুক
ফ্লোরিডা বে-র হালকা বাদামি অগভীর পানিতে নীল-ডানা টিল পাখি খাবারের খোঁজে ডুবে গিয়ে সাময়িকভাবে শিল্পকর্মের মতো চিত্র সৃষ্টি করেছে, যা প্রকৃতির গতিশীলতা ও রঙের খেলা একত্রে তুলে ধরে।

ম্যানগ্রোভের ফুল – কৌশিক ঘোষ
ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুসরণের পর এক বিকেলে ম্যানগ্রোভের হেথাল গাছের নিচ থেকে এক বাঘ বেরিয়ে এসেছে—যেন বুনো ফুলের মতো ফুটে উঠেছে। শিকারি ও আবাসস্থলের এক মনোমোহক মিলন হিসেবে ইমেজটি দেখা যায়।




















