দীর্ঘদিনের জলসংকট ও সীমিত সংযোগ
উত্তরাখণ্ডের দেরাদুন, ঋষিকেশ, হরিদ্বার ও হালদোয়ানির শহরতলির পরিবারগুলো বছরের পর বছর নিরাপদ পানির জন্য সংগ্রাম করেছে। সে সময়ে মাত্র ৪৫ শতাংশ বাসায় পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি পৌঁছাত, তাও ছিল অনিয়মিত ও সন্দেহজনক মানের। অনেককে সরকারি ট্যাংকারের লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়াতে হতো, আবার কেউ কেউ মহার্ঘে বোরওয়েল খনন করত কিংবা ব্যয়বহুল পাম্প ও পরিশোধন যন্ত্র বসাত।
২৪ ঘণ্টার নিরাপদ পানি: নতুন বাস্তবতা
বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় রাজ্য সরকার যে আধুনিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে, তার ফলে এখন ২২ টি উপশহর এলাকায় প্রায় ৫ লাখ ৪৪ হাজার মানুষ—অর্থাৎ ৯৫ শতাংশ পরিবার—প্রতিদিন ১৬ থেকে ২৪ ঘণ্টা পরিষ্কার পাইপের পানি পাচ্ছে।
নারীর সময়মুক্তি ও জীবনমানের উন্নয়ন
আগে পরিবারের পানি সংগ্রহের দায় নারীদের কাঁধেই ছিল। এখন তারা সেই অবর্ণনীয় কষ্ট থেকে মুক্ত হয়ে কৃষিকাজ, ক্ষুদ্র ব্যবসা কিংবা চাকরিতে সময় দিতে পারছেন। শিশুদের আর স্কুল মিস করতে হচ্ছে না; বরং পড়াশোনায় মনোযোগী হতে পারছে।
মিটারের মাধ্যমে সাশ্রয়ী ও টেকসই ব্যবস্থাপনা
সব সংযোগে মিটার বসিয়ে ব্যবহার ভিত্তিক বিল নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রথম ২০ হাজার লিটার পানির জন্য মাসে ন্যূনতম ২২০ টাকা, অতিরিক্ত প্রতি ১,০০০ লিটারে ১৫ টাকা ধরা হয়েছে। গড়ে একজন গ্রাহকের মাসিক বিল ৩৫০ টাকার মতো; বেশি ব্যবহারকারীর ক্ষেত্রে ৬০০–৮০০ টাকা। মাত্র এক বছরে বিল পরিশোধের হার ৩০–৪০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭০–৯০ শতাংশে নেওয়া গেছে।
অর্থনৈতিক সাশ্রয় ও স্বাস্থ্য সহায়তা
নতুন ব্যবস্থায় পানি প্রবাহের চাপ যথেষ্ট হওয়ায় বৈদ্যুতিক পাম্প চালাতে হচ্ছে না, ফলে বিদ্যুৎ বিল কমছে। খরচ সাশ্রয়ের আরেকটি বড় ক্ষেত্র হলো পরিশোধন যন্ত্র। আগে যাদের অতিরিক্ত ফিল্টার কিনতে ১৮,০০০ টাকা এবং রক্ষণাবেক্ষণে বছরে ৩,৫০০–৬,০০০ টাকা লাগত, তারা এখন সে ব্যয় থেকে মুক্ত। নিরাপদ পানির ফলে পানিবাহিত রোগও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
জলের বুদ্ধিমান ব্যবহার ও দ্রুত সেবাপ্রাপ্তি
মিটার বসানো হওয়ায় সবাই সচেতনভাবে পানি ব্যবহার করছে; আগে যা অবাধে নষ্ট হতো, তা এখন এক বালতি পানিতেই গাড়ি ধোয়ানো হচ্ছে। ৯৭ শতাংশ অভিযোগ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সমাধান হচ্ছে—যা গ্রাহক সন্তুষ্টি নিশ্চিত করেছে।
সংস্থার আর্থিক স্বনির্ভরতা ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ
২২টির মধ্যে ২০ টি এলাকায় অপারেশন ও প্রশাসনিক খরচ পূরণ করে স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে পানি সংস্থাগুলো। উন্নত লিক-ডিটেকশন প্রযুক্তির কারণে পানির অপচয় ৪০ শতাংশ থেকে নেমে ২৫ শতাংশে এসেছে, আর দক্ষ পাইপলাইন সিস্টেমে প্রতি বছর বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়েছে প্রায় ২২.৫ কোটি টাকা—যা কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে ৪,৫০০ গাছ রোপণের সমতুল্য পরিবেশ-সাশ্রয় দিয়েছে।
গ্রাহককেন্দ্রিক চিন্তাধারা: সাফল্যের মূলমন্ত্র
আগে প্রকৌশলীরা শুধু অবকাঠামো নির্মাণকেই সাফল্য বলেই ধরে নিতেন; এখন তাঁরা পরিষেবার গুণমান ও স্থায়িত্বকেই মূল সূচক হিসেবে বিবেচনা করেন। এই ‘গ্রাহক প্রথম’ ধারণা পুরো উদ্যোগের চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে।
ভবিষ্যৎ লক্ষ্য ও অন্য রাজ্যের জন্য শিক্ষা
২০২৫ সালের এই সাফল্যের আলোকে উত্তরাখণ্ড ২০৩০ সালের মধ্যে রাজ্যের সব মানুষের জন্য নিরবচ্ছিন্ন, পরিশোধিত ও চাপযুক্ত পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে চায়, যেখানে অন্তত ৬০ শতাংশ সংযোগ মিটারযুক্ত হবে। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের জন্য শিক্ষাটি স্পষ্ট: শুধু অবকাঠামো গড়া নয়, বরং উচ্চমানের নিরবচ্ছিন্ন পরিষেবা দেওয়া জরুরি। এতে নাগরিকদের জীবনমান যেমন উন্নত হয়, তেমনি রাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের পানির সংকট সমাধানের পথও সুগম হয়।