বিষখালি নদীর পরিচয়
দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলে প্রবাহিত বিষখালি নদী বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদ-নদীর মধ্যে অন্যতম। বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পটুয়াখালীর বাউফল ও কলাপাড়া হয়ে এটি বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। নদীটির উৎস সুগন্ধা নদী থেকে, যা নিজে কীর্তনখোলা এবং সন্ধ্যার সঙ্গে যুক্ত। বিষখালি নদী শুধু একটি জলপ্রবাহ নয়, বরং এই অঞ্চলের কৃষি, ব্যবসা, যাতায়াত এবং জেলেদের জীবিকার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
নদীর উৎস ও সংযোগ: এক বিস্তৃত জলপথের নেটওয়ার্ক
বিষখালি নদীর উৎপত্তি হয়েছে সুগন্ধা নদী থেকে, যা ঝালকাঠির উত্তরে অবস্থিত। সুগন্ধা নদী নিজে কীর্তনখোলা নদীর একটি শাখা। বিষখালি নদী এরপর ঝালকাঠির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণে গিয়ে পটুয়াখালীর বাউফল ও কলাপাড়া উপজেলা অতিক্রম করে শেষমেশ বঙ্গোপসাগরের কোলে গিয়ে মিশেছে। পথে এটি সন্ধ্যা নদীর সাথেও সংযুক্ত হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। ফলে, বিষখালি একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী-সংযোগকারী রুট হিসেবে কাজ করে, যা দক্ষিণাঞ্চলের পানি যোগাযোগকে সহজ করেছে।

কৃষিতে নদীর অবদান: সেচ, উর্বরতা ও উৎপাদন
বিষখালি নদী তীরবর্তী অঞ্চলের কৃষকের জন্য এক আশীর্বাদস্বরূপ। বর্ষার সময় এই নদীর বন্যার পানি আশেপাশের জমিতে পলি এনে জমির উর্বরতা বাড়িয়ে দেয়। শীতকালে এই নদীর পানিই হয় সেচের প্রধান উৎস। কলাপাড়া, বাউফল ও ঝালকাঠি এলাকার কৃষকরা বিষখালি নদীর পানি ব্যবহার করে ধান, পাট, শাকসবজি ও অন্যান্য ফলনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। নদীর আশেপাশে কৃষিজমি গড়ে উঠেছে শত বছর ধরে—যার ভিত্তি হল এই নদীর ধারা।
ব্যবসা ও পণ্য পরিবহনে ভূমিকা
বিষখালি নদীর আরেকটি বড় ভূমিকা হলো ব্যবসা ও পণ্য পরিবহন। এই নদী পথে ঝালকাঠি, রাজাপুর, বাউফল এবং কলাপাড়া অঞ্চলের পণ্য, যেমন চাল, শাকসবজি, মাছ, কাঠ, এমনকি নৌকার কাঠামোও আনা–নেওয়া করা হয়। বিশেষ করে বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলার পণ্য পরিবহনের জন্য বিষখালি এক গুরুত্বপূর্ণ রুট। আশেপাশের হাটবাজারগুলো এই নদীর কূল ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে।

জনসাধারণের যোগাযোগ ব্যবস্থা: একসময়ের ভরসা, এখনো গুরুত্বপূর্ণ
একসময় বিষখালি নদী ছিল দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের প্রধান পথ। তখনকার দিনে রাস্তাঘাটের অভাবে নৌকাই ছিল একমাত্র উপায়। এই নদী দিয়ে পাটের নৌকা, পণ্যবাহী লঞ্চ, যাত্রীবাহী সাঁজানো নৌকা চলত নিয়মিত। এখন সড়কপথ বিস্তৃত হলেও বিষখালি নদীর গুরুত্ব কমেনি। অনেক প্রত্যন্ত এলাকায় এখনো নৌকা ও ট্রলারই প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম। বিশেষ করে বর্ষাকালে এই নদীপথই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য।
দুই তীরে সবুজ বনানী: এক হারিয়ে যাওয়া সৌন্দর্য
এক সময় বিষখালি নদীর দুই তীরে ছিল ঘন বনাঞ্চল। নারকেল, সুপারি, তালগাছ, কাঁঠাল, আমগাছের সারি নদীর তীরে সবুজ প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। বর্ষাকালে এই নদী যখন ফুলে-ফেঁপে উঠত, তখন নদীর দুই তীরের সৌন্দর্য দেখে মনে হতো যেন এক জলপরি রাজ্য। এখনো কিছু এলাকায় এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছাপ পাওয়া যায়, তবে ক্রমাগত দখল, নদীভাঙন ও অব্যবস্থাপনায় অনেকটাই হারিয়ে গেছে সেই দৃশ্য।
বিষখালির মাছ: জীবন ও খাদ্যের উৎস
বিষখালি নদী তার মাছের জন্যও বিখ্যাত। ইলিশ, পুঁটি, ট্যাংরা, চিংড়ি, শোল, বোয়াল, আইড়, বাইম ইত্যাদি মাছ এক সময় ছিল প্রচুর পরিমাণে। এখনও এই নদীর বুকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে হাজার হাজার জেলে পরিবার। বিশেষ করে বর্ষা ও শরৎকাল ইলিশ মাছ ধরার মৌসুম হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় বাজারে বিষখালির মাছের আলাদা কদর আছে। অনেকেই বলেন, বিষখালির ইলিশের স্বাদ পদ্মার চেয়ে কম নয়।

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের বর্তমান চিত্র
বিষখালি নদী একসময় জীববৈচিত্র্যের আধার ছিল। নদীতে ছিল ডলফিন, নানা ধরনের কচ্ছপ ও জলচর পাখি। কিন্তু এখন নদীর ওপর দখল, বর্জ্য ফেলা, অবৈধ চিংড়ি চাষ ও অতিরিক্ত নৌযান চলাচলের ফলে এই জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। অনেক প্রজাতির মাছ ও প্রাণী এখন আর দেখা যায় না। নদীর গভীরতা ও প্রবাহ কমে যাওয়াও এক বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিষখালির ভবিষ্যৎ রক্ষায় উদ্যোগ দরকার
বিষখালি নদী শুধু একটি জলপথ নয়, এটি দক্ষিণ বাংলার মানুষের জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কৃষি, ব্যবসা, যাতায়াত, সৌন্দর্য এবং খাদ্যের উৎস হিসেবে এই নদী একটি সম্পদ। কিন্তু পরিবেশগত অবক্ষয়, অব্যবস্থাপনা ও অবৈধ দখলের কারণে বিষখালি নদী এখন ঝুঁকির মুখে। সরকার, স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এই নদীকে রক্ষা করা সম্ভব নয়।
নদীর প্রাণ ফিরলে ফিরবে কৃষি, বাড়বে মাছের উৎপাদন, সচল হবে নদীপথ, আর বাঁচবে বিষখালিকে ঘিরে গড়ে ওঠা একটি প্রজন্মের জীবন।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















