গত বছর এই দিনে কার্যত আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের এই পতন নিশ্চয়ই কোনো একটা কারণে ঘটেনি। অনেকগুলো কারণে ঘটেছে।
বাংলাদেশে অস্বাভাবিকভাবে সরকার পতনই স্বাভাবিক ঘটনা। দেশটি সৃষ্টির পর থেকে একমাত্র ২০০১-এ শেখ হাসিনার সরকার ছাড়া আর কোনো সরকারের স্বাভাবিক ক্ষমতা হস্তান্তর হয়নি। আর কেন এ দেশটিতে স্বাভাবিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হয় না—এর শিকড় নিশ্চয়ই অনেক গভীরে—নইলে এতদিনে সকলে বুঝতো কেন স্বাভাবিকভাবে এ দেশে সরকার পরিবর্তন হয় না।
আওয়ামী লীগের এবারের সরকারের পতনের পরেও অনেক ন্যারেটিভ সৃষ্টি হচ্ছে, আরও ন্যারেটিভ সৃষ্টি হবে। কেন এভাবে পতন হলো তা আসলেই এখনও দেশের মানুষের কাছে খুব বেশি পরিষ্কার নয়।
তবে পতনের একটি কারণ খুব সহজে বলা যায়—তা হলো আওয়ামী লীগ একটি বিশাল কর্মী-সমর্থিত রাজনৈতিক দল হিসেবে ক্ষমতায় গিয়েছিল ২০০৮ সালে, আর ২০২৪-এর ৫ আগস্ট যখন তার পতন হয়, সে সময়ে তার বিশাল কর্মীবাহিনী ছিল নিষ্ক্রিয়।
আওয়ামী লীগের বিশাল কর্মীবাহিনী ২০২৪-এ যখন তাদের সরকারের পতন হয়, সে সময়ে তারা নিষ্ক্রিয় ছিল; এখন তারা কী অবস্থায় আছে তা বলা সম্ভব নয়, কারণ দলটির কার্যক্রম সরকারের নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ।

তবে বর্তমান ইন্টারিম সরকারের প্রেস সচিব থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকার পতনে যাদের ভূমিকা ছিল, এখনও যারা মিডিয়ায় কথা বলেন, তাদের অনেকে বলেন, তারা খোঁজখবর নিয়ে দেখেছে আওয়ামী লীগের কোনো কর্মী—আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেনি। দেশের অন্যতম বাংলা সংবাদপত্র প্রথম আলো আওয়ামী লীগের একটি দুর্বল বেল্ট রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে একটি সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই রিপোর্টেও দেখা যায়, আওয়ামী লীগ কর্মীরা বলছে, তারা এখন চুপচাপ আছে, নিজেকে আড়ালে রেখে চলে। তবে আওয়ামী লীগ ও তার মূল নেতার ওপর তাদের আস্থার কোনো ঘাটতি নেই।
আওয়ামী লীগ কর্মীদের এই আচরণ দেখে অনেকে প্রশ্ন করে বা বিভিন্ন লেখা ও টকশোতে বলে, সরকার বিরোধী আন্দোলন দমন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ এত মানুষ হত্যা করেছে, তারপরেও তাদের কোনো কর্মীরই কোনো অনুতাপ নেই কেন। এবং কেন তারা তাদের দল ও মূল নেতার প্রতি অনুগত। এটাকে অনেকেই ওই সব কর্মী বা সমর্থকদের একটি ঘৃণ্য মানসিকতা বলেও মনে করে।
অন্যদিকে প্রায় আশি বছরের এই রাজনৈতিক দলটি, যা এখন নিষিদ্ধ—এই দলটির কর্মীদের চরিত্র যারা জানে, তারা অধিকাংশই বলবে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে সেখানে কিছু ভিন্ন ধরনের ভালো ও মন্দ মানুষের আগমন ঘটে ক্ষমতার চারপাশে। অন্যদিকে রুট লেভেলে আওয়ামী লীগ কর্মীদের কাছে আওয়ামী লীগ শুধু একটা রাজনৈতিক দল নয়, এটা অনেকখানি তাদের কাছে ধর্মের মতো। আর এই দলটি মূলত মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে শুরু হলেও দলটির মূল কাল্ট ভাসানী নন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যেহেতু পূর্ব বাংলা পীর-আউলিয়াদের এলাকা, তাই এখানে দলের কর্মীরা অনেকটা পীরের মুরিদের মতো। যে কারণে শেখ মুজিবকে স্মরণ করে যিনি দলের দায়িত্ব নেন, তিনি অনেকটা গদিনশীন পীরের মতো হয়ে যান এই দলের কর্মীদের কাছে। পীরের মুরিদের যেমন এক অকুণ্ঠ আনুগত্য থাকে—এদেরও ঠিক একই ধরনের। আর প্রথম আলোর রিপোর্ট সেটাই প্রমাণ করে।
এখন প্রশ্ন হলো, এ ধরনের কর্মী থাকতে কেন তাদের দলের সরকার এমন তাসের ঘরের মতো বা পুরোনো জমিদার বাড়ির মতো ভেঙে পড়লো? কেন কর্মীরা এভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল?

২০১২, ১৩, ও ১৪-তে ঠিক একই ধরনের আন্দোলন হয়েছিল। ২০১২-তে হেফাজত যখন গোটা ঢাকাকে দখল করে নেয়, সে সময়ে আওয়ামী লীগের মহাজোট সরকারের অংশ জাতীয় পার্টি থেকে শুরু করে বিএনপি, জামায়াতসহ সব সেন্টার-রাইট ও রাইটিস্ট দলগুলো হেফাজতকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু তখন ঢাকা শহর থেকে শুরু করে সারাদেশে আওয়ামী লীগ কর্মীরা সক্রিয় ছিল রাজপথে।
এবার কেন তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল আন্দোলনের সময়। অথচ এখনও তারা তাদের সমর্থন ঠিকই আওয়ামী লীগের ওপর রেখেছে। আর এই দলটির বিভিন্ন বিপর্যয়ের পরেও দেখা গেছে কমপক্ষে দেশের মোট মানুষের তিরিশভাগের বেশি মানুষের সমর্থন—যার অধিকাংশই কর্মী—এটা কখনই কমে না। অথচ এই কর্মীরা কেন নিষ্ক্রিয় ছিল?
একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আওয়ামী লীগের কর্মীরা কিন্তু ২০২৪-এর এই আন্দোলনের সময় নিষ্ক্রিয় হয়নি; তার অনেক আগে থেকেই নিষ্ক্রিয় হয়েছে। যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ প্রকাশ্যে আসে ২০২৩-এ ঢাকার অন্যতম অভিজাত এলাকা গুলশানের উপনির্বাচনে, যেখানে শেখ হাসিনা যাকে মনোনয়ন দেন এবং তিনি নিজে থেকে তাকে পাস করানোর জন্য বললেও—গুলশান-বনানীর কোনো প্রকৃত আওয়ামী লীগ কর্মী তার পক্ষে কাজ করেনি। ওই এলাকার বড় নেতারা নানান অজুহাতে বিদেশে চলে যায় নির্বাচনের আগে, আর বাদবাকিরা বাড়িতে বসে থাকে। যে কারণে একজন গ্রামীণ ইউটিউবার হিরো আলমের কাছে প্রকৃত অর্থে আওয়ামী লীগের ওই প্রার্থী হেরে যায়—তাকে অন্যায়ভাবে পাস করানোর প্রয়োজন পড়ে। এমনকি হিরো আলমকে ঠেকানোর জন্য গুন্ডা দিয়ে বারবার তার ওপর হামলা করানো হয়।
যে এলাকায় নির্বাচনী প্রক্রিয়াটি হয়েছিল, এটা ঢাকার ডিপ্লোম্যাটিক জোন। তাই বিদেশি যারা স্মার্ট ডিপ্লোম্যাট এবং ডিপ্লোম্যাটের কভারে বিদেশি যেসব ইন্টেলিজেন্সের স্মার্ট লোকজন বৈধভাবে এখানে ওই সময় ছিল, তারা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দীনতা স্পষ্টভাবে দেখতে পায়। আর এটা দেখার পরে অনেকেরই রণনীতি সাজানো সহজ হয়ে ওঠে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক এই দীনতা কেন দেখা দিল? কেন কর্মীরা চুপ হয়ে গেল? কবে থেকে এই ধারা শুরু হয়? বাস্তবে এই ধারা শুরু হয় সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে সরিয়ে দিয়ে ওবায়দুল কাদেরকে জেনারেল সেক্রেটারি করার পর থেকেই ধীরে ধীরে।
ওবায়দুল কাদের সংগঠনের প্রথম স্ট্রাকচারটি ভেঙে ফেলে দলের যোগ্য সাংগঠনিক সম্পাদকদের বাদ দিয়ে। এবং বিষয়টা অনেকটা ওপেন সিক্রেট হয়ে যায় যে, তিনি অর্থের বিনিময়ে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক নিয়োগের পথ নেন। এবং যারা দলের প্রতি অনুগত তাদেরকে দলের কাজ থেকে দূরে ঠেলে দেন। এই সাংগঠনিক সম্পাদকরাই সারাদেশে জেলা কমিটি নিয়োগ দেয়, আর সেখানেও শুরু হয় বাণিজ্য। যোগ্যতার বদলে অর্থের বিনিময়ে নেতা হতে থাকে বেশি। এছাড়া কিছু অনভিজ্ঞ ও অরাজনৈতিক সুবিধাবাদী ওবায়দুল কাদেরকে ঘিরে একটা নেতৃত্বের বলয় তৈরি করে—যা দল থেকে কর্মীদের দূরে ঠেলে ফেলার আরেকটি অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব তৈরির দায়িত্বে ওবায়দুল কাদের দীর্ঘদিন ধরে। সে যে কাজ করে তা হলো, ছাত্রলীগকে সম্মেলনের মাধ্যমে, ভোটের মাধ্যমে নেতা তৈরির সুযোগ বন্ধ করে দেয়। তার বদলে ড্রয়িংরুমে অর্থের বিনিময়ে নেতা হতে থাকে। যার ফলে দেখা যায়, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরে বা সরকারপতনের আন্দোলনের একটা সময়ে এসে ছাত্রলীগের থেকে একটা অংশ চলে যায়। যারা এখন নিজেরাই নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে—কেউ জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠনের কর্মী, কেউ হিজবুত তাহরীরের কর্মী—এমনইভাবে সবাই রাইটিস্ট মতাদর্শী। এভাবেই দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগকে একটি অর্থ তৈরির মেশিন বানানোর ফলে তাদেরও শক্তি ও আদর্শ কমে যায়।
পাশাপাশি যুবলীগ আওয়ামী লীগের আরেকটি একটি অঙ্গসংগঠন। সেই যুবলীগের নেতৃত্ব যাকে দেওয়া হয়, সে ওই অর্থে রাজনীতিক নয়। যার ফলে দুই বছরের বেশি সময় দায়িত্বে থাকলেও দেশে ৭০ ভাগ এলাকায় যুবলীগের কমিটি করা সম্ভব হয়নি, এবং সেখানেও বড় লেনদেনের বিষয়টি অনেকটা ওপেন সিক্রেট ছিল। ঠিক একইভাবে আওয়ামী লীগের আরেকটি অঙ্গসংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগের যোগ্য নেতাদের ২০২২-এ সরিয়ে কেন অযোগ্যদের ও অসৎদের হাতে দেওয়া হয়, তা নিয়েও যেমন আওয়ামী লীগ কর্মীদের মধ্যে প্রশ্ন ওঠে, তেমনি তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
অন্যদিকে বাংলাদেশে যেহেতু সরকার পরিবর্তনের বিষয়টি সব সময়ই রাজধানী থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনের মাধ্যমে ফয়সালা হয়, তাই রাজধানীতে সব দলই তাদের সংগঠনকে শক্ত রাখতে চায়।

ঢাকার অভিজাত এলাকার আওয়ামী লীগের অবস্থা শেষ অবধি কী দাঁড়িয়েছিল তা আগেই উল্লেখ করেছি। অন্যদিকে ঢাকার মানুষ বলতে এখন পুরোনো ঢাকার মানুষই শক্তিশালী। পুরোনো ঢাকা মোগল আমল থেকে পঞ্চায়েতের মতো সর্দার ফ্যামিলি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যদিও সে নিয়ন্ত্রণ এখন আগের মতো শতভাগ নেই—তারপরেও তাদেরকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। ঢাকারই এক সর্দারের নাতি সাঈদ খোকন ঢাকা দক্ষিণের আওয়ামী লীগের মেয়র ছিল—তার বদলে পরিবারের লোক আলনেও সাঈদ খোকনকে কোনো সম্মানের জায়গায় বসানো হয়নি।
অন্যদিকে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল যে দুইজন নেতাকে—তারা ভদ্রলোক কিন্তু কেউই ঢাকা চেনে না, এবং ঢাকা শহর বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাদের কোনো পরিচয় কখনও ছিল না। অন্যদিকে কার স্বার্থে ঢাকা শহরের যুবলীগের উঠতি জনপ্রিয় নেতাদের দল থেকে বহিষ্কার ও নির্যাতন করা হলো, তা-ও একটা বড় প্রশ্ন।
এর পাশাপাশি একেবারে তৃণমূলে আওয়ামী লীগের সংগঠনকে নিষ্ক্রিয় করতে যে কাজটি করা হলো, সেটা উপজেলা চেয়ারম্যান থেকে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অবধি লোকাল গর্ভনমেন্টের সব প্রতিনিধিকে রাজনৈতিক প্রতীক ও দলীয় মনোনয়ন দেয়া।
এখানেও ওপেন সিক্রেট যে, দলের সেক্রেটারি থেকে জেলার প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারি সকলেই টাকার বিনিময়ে এই মনোনয়ন বাণিজ্য করে। ফলে তৃণমূলে আগে একটা বিষয় ছিল—আওয়ামী লীগের যে কোনো দুঃসময়ে নির্দলীয়ভাবে (যেহেতু সে সময় এ নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে হতো) আওয়ামী লীগই মেজরিটি থাকতো, তাদের জয়ী হবার মূল কারণ দেখা যেত, তারা স্থানীয়ভাবে জনসেবাকারী মানুষ।
যেহেতু ওইস জনসেবাকারী নেতাদের অবৈধ অর্থ ছিল না, তাই তারা এ মনোনয়ন বাণিজ্যের কাছে হেরে গেল। এর বদলে বিভিন্ন স্থান থেকে যারা চাঁদাবাজি করে, মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, নদীর বালু চুরির সঙ্গে জড়িত—এই ধরনের মানুষরা বেশিক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিল তৃণমূলে। যে কারণে তৃণমূলের কর্মীরা শুধু নির্বাচন থেকে, ভোট দেওয়া থেকে সরে যায়নি; তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
এমনিভাবে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কর্মীদের নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া সরকার পতনের একটি কারণ বলে ধরা যায়। কারণ, শেষ বিচারে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় যায় তার কর্মী ও সমর্থকদের জোরে, আর ক্ষমতা হারায় কর্মী ও সমর্থকদের নিষ্ক্রিয়তার কারণে।
লেখক: বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ, The Present World
( লেখাটি India Today এ প্রকাশিত হয়েছে। এখানে তার বাংলা অনুবাদ দেয়া হলো)

স্বদেশ রায় 



















