একই সংকট, ভিন্ন প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কা—দুই দক্ষিণ এশীয় দেশেই সাম্প্রতিক ইতিহাসে রাজনৈতিক সংকট, সরকার পতন, অর্থনৈতিক ধ্বস ও নেতৃত্ব পরিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। তবে এ দুটি দেশের জনগণের প্রতিক্রিয়া ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে মানুষ প্রতিবাদ করলেও জনসাধারণ আইন ভাঙেনি, সরকারি-বেসরকারি সম্পদ লুটপাট বা অবৈধভাবে জমি-সম্পদ দখল করেনি। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৪৬ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যেকোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা ও শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনের সময় জনগণের একটি অংশ সক্রিয়ভাবে লুট, দখল ও সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে। প্রশ্ন ওঠে—কেন এই ভিন্নতা?
ইতিহাসের ছায়া: ১৯৪৬ থেকে শুরু
১৯৪৬ সালের কলকাতা ও নোয়াখালীর দাঙ্গায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এবং গণহিংসার মধ্যেই প্রথম দেখা যায় ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত লুটপাটের প্রবণতা। ১৯৪৭-এর দেশভাগে পরিত্যক্ত সম্পদ দখল এবং দাঙ্গায় শত্রুর সম্পত্তি লুট করা অনেকের কাছে বৈধ মনে হয়েছিল। এরপর ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং পরবর্তী স্বাধীনতা-পরবর্তী শূন্যতা—এই দুটো সময়েও একই প্রবণতা দেখা যায়। বিশেষ করে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হিন্দুদের সম্পত্তি লুঠ ও দখল ও স্বাধীনতার পরে পাকিস্তানি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, বিহারিদের সম্পদ দখল, এবং সরকারি জমি ও বাড়ি বেসরকারিভাবে দখল করা শুরু হয় তখন থেকেই।

সামাজিক ও মানসিক কাঠামো: অভাব, লোভ ও নৈতিক সংকট
বাংলাদেশে লুট ও দখলের প্রবণতার মূল কারণ শুধু দারিদ্র্য নয়, বরং সামাজিকভাবে গড়ে ওঠা একধরনের মানসিকতা ও শিক্ষার অভাব। একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে অবিচার, দারিদ্র্য ও দুর্নীতির মধ্যে বসবাস করায় রাষ্ট্রীয় সম্পদকে “সবার” বা “কাউকারো না” হিসেবে দেখার মানসিকতা তৈরি হয়েছে। পরিবারে এবং শিক্ষায় নাগরিক মূল্যবোধ, আইন মানার সংস্কৃতি, বা অন্যের সম্পদকে শ্রদ্ধা করার শিক্ষা অনুপস্থিত। ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা এলেই তারা ভাবে, এখনই সুযোগ সম্পদ দখল বা লুট করার।
রাজনৈতিক মদদ ও বিচারহীনতা
বাংলাদেশে প্রতিটি রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়—হোক তা ১৯৭৫-পরবর্তী কাল, ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তন, বা ২০২৪ সালের আন্দোলন-পরবর্তী সময়—সরকারি ও রাজনৈতিক মদদপুষ্ট একটি গোষ্ঠী সাধারণ জনগণকে উসকে দিয়ে দখল ও লুটপাটে সহায়তা করে। তারপর এসব অপরাধীদের বিচার হয় না, বরং অনেক ক্ষেত্রে তারা পুরস্কৃতও হয়। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি নতুন নতুন দখলদার ও লুটেরা তৈরি করে।

শ্রীলঙ্কার ভিন্নতা: শিক্ষিত মধ্যবিত্তের প্রতিক্রিয়া
শ্রীলঙ্কার জনগণ—বিশেষত মধ্যবিত্ত শ্রেণি—শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং আইন-শৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাদের আন্দোলন ছিল নিয়ন্ত্রিত ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন। প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে ঢুকেও তারা শুধু প্রতীকী প্রতিবাদ করে এবং কিছুই ভাঙচুর বা চুরি করে না। এই আচরণ তাদের সামাজিক ও শিক্ষাগত মানের পরিচয় বহন করে।
রাজনৈতিক ও সামাজিক শিক্ষা জরুরি
বাংলাদেশের পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষার পুনর্গঠন। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রকে একযোগে কাজ করতে হবে যাতে মানুষ বুঝতে পারে অন্যের সম্পদ লুট বা দখল কোনোভাবেই ন্যায়সঙ্গত নয়। পাশাপাশি, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারহীনতার অবসান ঘটাতে হবে।

একটি জাতিগত আত্মজিজ্ঞাসা
শুধু দারিদ্র্যই নয়—নৈতিক শিক্ষা, বিচারহীনতা, রাজনৈতিক মদদ ও সামাজিক অবক্ষয় মিলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটে লুটপাট ও দখলের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এই সংস্কৃতি যদি এখনই না থামানো যায়, তবে ভবিষ্যতের যেকোনো পরিবর্তন আবারও সহিংসতা ও অবৈধ দখলের সুযোগে পরিণত হবে। সময় এসেছে আত্মসমালোচনার, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি নৈতিক, সচেতন ও দায়িত্বশীল জাতি হিসেবে গড়ে তোলার।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















