কে এই হিমালয়ান মারমট?
হিমালয়ান মারমট (বৈজ্ঞানিক নাম: Marmota himalayana) হলো একধরনের বড় আকৃতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, যারা মূলত গুহাচারী জীবনযাপন করে এবং হিমালয়ের উঁচু পাহাড়ি তৃণভূমিতে বাস করে। এরা বাঁদরের মতো সামাজিক জীব এবং সাধারণত দলবদ্ধভাবে বসবাস করে। হিমালয়ের ভারতীয় অঞ্চল, নেপাল, ভুটান, এবং দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের তিব্বতীয় মালভূমিতে এদের দেখতে পাওয়া যায়।
শারীরিক গঠন ও আচার-আচরণ
হিমালয়ান মারমট দেখতে অনেকটা বড় আকৃতির একটি কাঠবিড়ালির মতো, তবে শরীরের গঠন অধিক শক্তিশালী এবং লোম অনেক ঘন। প্রাপ্তবয়স্ক মারমটের ওজন হয় ৪ থেকে ৯ কেজি পর্যন্ত এবং দেহের দৈর্ঘ্য হয় ৪৫ থেকে ৬৭ সেন্টিমিটার পর্যন্ত। এদের লোম ঘন, বাদামি ও সোনালি রঙের মিশ্রণে গঠিত, যা ঠান্ডা থেকে বাঁচতে সাহায্য করে।
এরা দিনে সক্রিয় থাকে এবং রাতের বেলা গুহায় ফিরে যায়। মারমটেরা খুব চঞ্চল ও সতর্ক প্রকৃতির। সামান্য শব্দেও তারা নিজেদের গর্তে লুকিয়ে পড়ে এবং সতর্কবার্তা হিসেবে উচ্চস্বরে চিৎকার করে।

বাসস্থান: বরফের নিচে উষ্ণ এক সংসার
মারমটেরা মাটির নিচে গর্ত করে সেখানে বসবাস করে। এক একটি গর্তে একাধিক মারমটের পরিবার থাকতে পারে এবং এসব গর্ত অনেক জটিল ও গভীর হয়। শীতকালে যখন হিমালয় তুষারে ঢেকে যায়, তখন এরা ৬-৭ মাস হাইবারনেশন বা নিদ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে। এই সময় তারা গুহার বাইরে বের হয় না এবং শরীরে জমা হওয়া চর্বি থেকেই তারা শক্তি সংগ্রহ করে।
খাদ্যাভ্যাস: তৃণভোজী এই প্রাণী
হিমালয়ান মারমট প্রধানত ঘাস, ভেষজ গাছপালা, শাকসবজি, ফুল ও ফলও খায়। গ্রীষ্মকালীন সময়ে তারা অনেক বেশি পরিমাণে খাদ্য সঞ্চয় করে, যা শীতকালে কাজে লাগে। প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রে এদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, কারণ তারা মাটির গঠন পরিবর্তনে সাহায্য করে এবং বিভিন্ন বীজ ছড়াতে সাহায্য করে।
সামাজিকতা ও বংশবিস্তার
মারমটেরা পরিবারভিত্তিক দল গঠন করে বসবাস করে। একটি দলে প্রায় ১০-১৫টি সদস্য থাকতে পারে। বংশবিস্তার সাধারণত গ্রীষ্মে ঘটে। স্ত্রী মারমট প্রতি প্রজনন মৌসুমে ২-৫টি শাবকের জন্ম দেয়। শাবকরা প্রথমে অন্ধ ও লোমহীন হয়, তবে ধীরে ধীরে তারা পূর্ণবয়স্কতা অর্জন করে।

হুমকি ও সংরক্ষণ
হিমালয়ান মারমট এখনও পর্যন্ত ‘Least Concern’ (সামান্য বিপদাপন্ন নয়) হিসেবে আইইউসিএন লাল তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। তবে জলবায়ু পরিবর্তন, বাসস্থান ধ্বংস, অবৈধ শিকার এবং পর্যটনের অযাচিত প্রভাব এদের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে।
বিশেষ করে ভারতীয় লাদাখ অঞ্চলে সামরিক প্রশিক্ষণ ও সড়ক নির্মাণে মারমটের গর্ত ধ্বংস হচ্ছে। তিব্বত এবং চীনে কেউ কেউ ভুলবশত বিশ্বাস করে যে, মারমটের মাংস ও চর্বি ঔষধিগুণসম্পন্ন, যার ফলে শিকার বেড়ে যাচ্ছে।
পরিবেশগত গুরুত্ব
হিমালয়ান মারমট ভূমির উপরে ও নিচে বাসস্থান গড়ে তোলে, যা মাটির গঠন উন্নত করে এবং পানি ধারণক্ষমতা বাড়ায়। এছাড়া, এই প্রাণীরা তৃণভোজী হওয়ায় প্রাকৃতিক ঘাসভূমি নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং তাদের উপস্থিতি হিমালয়ের বাস্তুতন্ত্রকে ভারসাম্যপূর্ণ রাখে। শিকারী প্রাণী যেমন হিমচিতা ও রেড ফক্সদের জন্যও মারমট একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উৎস।

পর্যটনে আকর্ষণ
হিমালয়ের লাদাখ, স্পিতি উপত্যকা, বা নেপালের কিছু অঞ্চল ভ্রমণ করলে কখনও কখনও পথের পাশে মারমটের দল দেখা যায়। তারা পর্যটকদের দেখে প্রায়ই আগ্রহ প্রকাশ করে। অনেক পর্যটক ভুলভাবে এদের খাওয়ান বা ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেন, যা মারমটের স্বাভাবিক আচরণে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
একটি সংরক্ষিত ভবিষ্যতের জন্য সচেতনতা জরুরি
হিমালয়ান মারমট শুধু একটি প্রাণী নয়, বরং হিমালয়ের বাস্তুতন্ত্রের একটি অপরিহার্য অংশ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই মারমটদের নিরাপদ বাসস্থান নিশ্চিত করা, তাদের আচরণ না বিঘ্নিত করা এবং গুজবভিত্তিক শিকারের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা সময়ের দাবি।
একটি জীবন্ত হিমালয় দেখতে চাইলে, আমাদের উচিত হিমালয়ান মারমটদের জীবন, পরিবেশ এবং ভবিষ্যৎ রক্ষা করা।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















