০৫:১৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫
নরওয়ের বড়দিনে বিতর্কিত খাবার লুটেফিস্কের প্রত্যাবর্তন, ঐতিহ্যেই ফিরছে স্বাদ প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা (পর্ব-৩৪৫) নিউজিল্যান্ডে গ্যাং প্রতীক নিষিদ্ধ: রাস্তায় শান্তি, কিন্তু অপরাধ কি সত্যিই কমল সৌদিতে বিরল তুষারপাতের পর প্রশ্ন: সংযুক্ত আরব আমিরাতেও কি আবার তুষারপাত সম্ভব? যে রিকশায় গুলিবিদ্ধ হন হাদি, সেই চালকের আদালতে জবানবন্দি তারেক রহমানের নেতৃত্বে নির্বাচনে আমরা জয়ী হবো: মির্জা ফখরুল পারমাণবিক সাবমেরিন থেকে কে-৪ ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা ভারতের তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনে বহুদলীয় গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হবে: নাহিদ ঢাকা-১৫ আসনে জামায়াত আমিরের পক্ষে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ মগবাজারে ককটেল বিস্ফোরণে শ্রমিক নিহত, অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে মামলা

জীবনের শেষ বেলায়ও লড়াই: ৬০ বছরের এক কর্মীর বৃষ্টিভেজা ক্লান্তিকর পথচলা

বেতনহীন জীবনের ছয় মাস

ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মো. মকবুল হোসেন। বয়স ৬০ বছর পেরিয়েছে। তিন দশকের বেশি সময় তিনি এই কোম্পানিতে চাকরি করছেন। কিন্তু গত ছয় মাস ধরে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসায়িক মন্দার কারণে বেতন দিতে পারছে না। পরিবার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। বাজারের ঊর্ধ্বমূল্য, ওষুধপত্রের দাম, ঘরভাড়া—সবকিছুর চাপ এখন তার কাঁধে। অথচ মাসের শেষে মকবুল হোসেনের হাতে কোনও টাকাই আসে না।

বাসা থেকে অফিস হেঁটে: টাকার সাশ্রয়ের করুণ যুদ্ধ

বেতনের অনিশ্চয়তা আর আর্থিক সংকটে পড়ে মকবুল হোসেন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন — আর কোনোভাবেই রিকশা বা বাসে অফিস যাবেন না। ঢাকার মিরপুর থেকে মতিঝিলে তার অফিস, দূরত্ব প্রায় ৯ কিলোমিটার। প্রতিদিন সকাল সাড়ে সাতটার দিকে তিনি হাঁটা শুরু করেন। প্রায় দুই ঘণ্টা হেঁটে পৌঁছান অফিসে। আবার অফিস শেষে সেই একই পথে ফিরে আসেন বাড়ি।

তার ভাষায়, “টাকাও নেই, শরীরটাও আর আগের মতো চলে না। কিন্তু খরচ কমাতে হেঁটেই যাই। না হলে তো সংসার চলবে না।”

Commuters suffer as rain causes intense traffic congestion on city roads |  The Business Standard

গরমবৃষ্টিযানজটসব পেরিয়ে ক্লান্তির নাম মকবুল

ঢাকার রাস্তায় সকাল থেকে তীব্র যানজট, গরম আর বৃষ্টির যন্ত্রণা। হাঁটার পথেও নেই শান্তি। ফুটপাথ ভাঙা, অনেক জায়গায় দোকান আর অবৈধ দখলদারদের দাপট দেখা যায়। তার মধ্য দিয়েই মকবুল হোসেন এগিয়ে যান। কখনো হাঁটু পর্যন্ত পানিতে ডুবে গলির রাস্তা পার হন, কখনো ছাতা ভেঙে ভিজে যান বৃষ্টিতে।

এই বর্ষাকালে তার পুরনো হাঁটুর ব্যথা আরও বেড়েছে। পা ফুলে যায়, রাতে ঘুমাতে পারেন না। কিন্তু চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সামর্থ্যও নেই তার।

স্বাস্থ্যঝুঁকি: এক নিঃশব্দ মৃত্যুর পথে

বিশেষজ্ঞদের মতে, ৬০ বছরের একজন বৃদ্ধ মানুষের জন্য প্রতিদিন এতটা হাঁটা, বিশেষ করে যানবাহনের ধোঁয়া, বৃষ্টির ভেজা শরীর, গরমে ঘেমে যাওয়ার পর ঠাণ্ডা বাতাসে শরীর শুকিয়ে যাওয়া—সব মিলিয়ে এটি চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়। হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, হাঁপানি বা বাতের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেকগুণ বেড়ে যায়।

ডা. শামীমা নাসরিন বলেন, “বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। প্রতিদিন এত হাঁটাহাঁটি, বিশেষ করে বৃষ্টিতে ভেজা, ধুলাবালি আর দূষণের মধ্যে হাঁটা—এই বয়সে জীবননাশের কারণ হতে পারে।”

একটি রাষ্ট্রের নীরবতা

বাড়ছে বয়স্ক ও বিধবা ভাতা

মকবুল হোসেনের গল্প কেবল একজন মানুষের কষ্টের নয়, এটি একটি দেশের কর্মজীবী মানুষের অসম্মান ও অনিরাপত্তার প্রতিচ্ছবি। দীর্ঘদিনের শ্রমের বিনিময়ে বৃদ্ধ বয়সে একটু নিশ্চিন্তে জীবন যাপনের কথা ছিল তার। কিন্তু বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক অস্থিরতা, শ্রম আইন বাস্তবায়নের অভাব, আর দুর্বল সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে সেই নিশ্চিন্ত জীবন তার জন্য দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।

ভবিষ্যতের প্রশ্ন: কে দেখবে এই মানুষগুলোর দিকে?

মকবুল হোসেনের মতো মানুষরা সংখ্যায় কম নয়। প্রতিটি মোড়ে মোড়ে দেখা যায় বয়স্ক মানুষ অফিসে যাচ্ছেন ক্লান্ত মুখে, ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। এই মানুষেরা রাষ্ট্রের করদাতা, দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরানো একেকটি শক্তি। অথচ তারা আজ অবহেলিত, নিঃস্ব, উপেক্ষিত।

সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে তাদের জন্য কী নিরাপত্তা, কী সহানুভূতি—সবই অনুপস্থিত। প্রশ্ন থেকে যায়: তারা কতদিন এভাবে বাঁচবে? আর আমাদের বিবেক কতটা নিঃসংশয় হয়ে উঠলে এমন বাস্তবতায়ও আমরা নিশ্চুপ থাকি?

শেষ কথা

মকবুল হোসেন প্রতিদিন হাঁটেন, কারণ তার হাতে অন্য কোনো পথ নেই। তার হাঁটার পথ শুধু অফিসের গন্তব্য নয়, সেটি আমাদের সমাজের, ব্যবস্থার, আর রাষ্ট্রের উদাসীনতার প্রতি এক জীবন্ত প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদ কতদিন চলবে? আমরা কি কখনো তা শুনব? নাকি তাকে একদিন রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেই কেবল বলব—“বুড়ো মানুষটা মনে হয় খুব কষ্টে ছিল!”?

জনপ্রিয় সংবাদ

নরওয়ের বড়দিনে বিতর্কিত খাবার লুটেফিস্কের প্রত্যাবর্তন, ঐতিহ্যেই ফিরছে স্বাদ

জীবনের শেষ বেলায়ও লড়াই: ৬০ বছরের এক কর্মীর বৃষ্টিভেজা ক্লান্তিকর পথচলা

০৫:০৯:২১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৭ অগাস্ট ২০২৫

বেতনহীন জীবনের ছয় মাস

ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মো. মকবুল হোসেন। বয়স ৬০ বছর পেরিয়েছে। তিন দশকের বেশি সময় তিনি এই কোম্পানিতে চাকরি করছেন। কিন্তু গত ছয় মাস ধরে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসায়িক মন্দার কারণে বেতন দিতে পারছে না। পরিবার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। বাজারের ঊর্ধ্বমূল্য, ওষুধপত্রের দাম, ঘরভাড়া—সবকিছুর চাপ এখন তার কাঁধে। অথচ মাসের শেষে মকবুল হোসেনের হাতে কোনও টাকাই আসে না।

বাসা থেকে অফিস হেঁটে: টাকার সাশ্রয়ের করুণ যুদ্ধ

বেতনের অনিশ্চয়তা আর আর্থিক সংকটে পড়ে মকবুল হোসেন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন — আর কোনোভাবেই রিকশা বা বাসে অফিস যাবেন না। ঢাকার মিরপুর থেকে মতিঝিলে তার অফিস, দূরত্ব প্রায় ৯ কিলোমিটার। প্রতিদিন সকাল সাড়ে সাতটার দিকে তিনি হাঁটা শুরু করেন। প্রায় দুই ঘণ্টা হেঁটে পৌঁছান অফিসে। আবার অফিস শেষে সেই একই পথে ফিরে আসেন বাড়ি।

তার ভাষায়, “টাকাও নেই, শরীরটাও আর আগের মতো চলে না। কিন্তু খরচ কমাতে হেঁটেই যাই। না হলে তো সংসার চলবে না।”

Commuters suffer as rain causes intense traffic congestion on city roads |  The Business Standard

গরমবৃষ্টিযানজটসব পেরিয়ে ক্লান্তির নাম মকবুল

ঢাকার রাস্তায় সকাল থেকে তীব্র যানজট, গরম আর বৃষ্টির যন্ত্রণা। হাঁটার পথেও নেই শান্তি। ফুটপাথ ভাঙা, অনেক জায়গায় দোকান আর অবৈধ দখলদারদের দাপট দেখা যায়। তার মধ্য দিয়েই মকবুল হোসেন এগিয়ে যান। কখনো হাঁটু পর্যন্ত পানিতে ডুবে গলির রাস্তা পার হন, কখনো ছাতা ভেঙে ভিজে যান বৃষ্টিতে।

এই বর্ষাকালে তার পুরনো হাঁটুর ব্যথা আরও বেড়েছে। পা ফুলে যায়, রাতে ঘুমাতে পারেন না। কিন্তু চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সামর্থ্যও নেই তার।

স্বাস্থ্যঝুঁকি: এক নিঃশব্দ মৃত্যুর পথে

বিশেষজ্ঞদের মতে, ৬০ বছরের একজন বৃদ্ধ মানুষের জন্য প্রতিদিন এতটা হাঁটা, বিশেষ করে যানবাহনের ধোঁয়া, বৃষ্টির ভেজা শরীর, গরমে ঘেমে যাওয়ার পর ঠাণ্ডা বাতাসে শরীর শুকিয়ে যাওয়া—সব মিলিয়ে এটি চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়। হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, হাঁপানি বা বাতের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেকগুণ বেড়ে যায়।

ডা. শামীমা নাসরিন বলেন, “বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। প্রতিদিন এত হাঁটাহাঁটি, বিশেষ করে বৃষ্টিতে ভেজা, ধুলাবালি আর দূষণের মধ্যে হাঁটা—এই বয়সে জীবননাশের কারণ হতে পারে।”

একটি রাষ্ট্রের নীরবতা

বাড়ছে বয়স্ক ও বিধবা ভাতা

মকবুল হোসেনের গল্প কেবল একজন মানুষের কষ্টের নয়, এটি একটি দেশের কর্মজীবী মানুষের অসম্মান ও অনিরাপত্তার প্রতিচ্ছবি। দীর্ঘদিনের শ্রমের বিনিময়ে বৃদ্ধ বয়সে একটু নিশ্চিন্তে জীবন যাপনের কথা ছিল তার। কিন্তু বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক অস্থিরতা, শ্রম আইন বাস্তবায়নের অভাব, আর দুর্বল সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে সেই নিশ্চিন্ত জীবন তার জন্য দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।

ভবিষ্যতের প্রশ্ন: কে দেখবে এই মানুষগুলোর দিকে?

মকবুল হোসেনের মতো মানুষরা সংখ্যায় কম নয়। প্রতিটি মোড়ে মোড়ে দেখা যায় বয়স্ক মানুষ অফিসে যাচ্ছেন ক্লান্ত মুখে, ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। এই মানুষেরা রাষ্ট্রের করদাতা, দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরানো একেকটি শক্তি। অথচ তারা আজ অবহেলিত, নিঃস্ব, উপেক্ষিত।

সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে তাদের জন্য কী নিরাপত্তা, কী সহানুভূতি—সবই অনুপস্থিত। প্রশ্ন থেকে যায়: তারা কতদিন এভাবে বাঁচবে? আর আমাদের বিবেক কতটা নিঃসংশয় হয়ে উঠলে এমন বাস্তবতায়ও আমরা নিশ্চুপ থাকি?

শেষ কথা

মকবুল হোসেন প্রতিদিন হাঁটেন, কারণ তার হাতে অন্য কোনো পথ নেই। তার হাঁটার পথ শুধু অফিসের গন্তব্য নয়, সেটি আমাদের সমাজের, ব্যবস্থার, আর রাষ্ট্রের উদাসীনতার প্রতি এক জীবন্ত প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদ কতদিন চলবে? আমরা কি কখনো তা শুনব? নাকি তাকে একদিন রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেই কেবল বলব—“বুড়ো মানুষটা মনে হয় খুব কষ্টে ছিল!”?