জন্ম ও শৈশব
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র পারভীন সুলতানা দিতি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬৫ সালের ৩১ মার্চ নারায়ণগঞ্জ জেলায়। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন প্রাণবন্ত, মেধাবী এবং শিল্পকলায় গভীর অনুরাগী। গান, নাচ, আবৃত্তি ও নাটকে অংশগ্রহণ তার বিদ্যালয়জীবনের অন্যতম আনন্দ ছিল। সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠায় তার শিল্পীসত্তা ছোটবেলা থেকেই বিকশিত হয়। শৈশবে দিতির স্বপ্ন ছিল শিক্ষক হওয়া, কিন্তু ভাগ্যের লিখন তাকে নিয়ে যায় অভিনয়ের মঞ্চে।
অভিনয়ে প্রবেশের ইতিহাস
দিতির চলচ্চিত্রে প্রবেশ ছিল সৌভাগ্য ও প্রতিভার সমন্বয়। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি নাট্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে তিনি বিজয়ী হন। সেই প্রতিযোগিতায় তার অভিনয় প্রতিভা নজরে আসে বিখ্যাত নির্মাতা আমজাদ হোসেনের, যিনি তাকে চলচ্চিত্রে সুযোগ দেন। এই সুযোগই দিতির জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় এবং শুরু হয় তার দীর্ঘ ও গৌরবময় চলচ্চিত্রযাত্রা।
প্রথম চলচ্চিত্র ও সাফল্যের শুরু
দিতির প্রথম চলচ্চিত্র ছিল ডাক দিয়ে যায় (১৯৮৪)। প্রথম সিনেমাতেই তার স্বাভাবিক অভিনয় ও পর্দায় উপস্থিতি দর্শক ও সমালোচকের নজর কেড়ে নেয়। এরপর আমলা, আত্মত্যাগ ও চুমনামা চলচ্চিত্রে অভিনয় করে তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যান। ১৯৮৭ সালে স্বামী স্ত্রীর যুদ্ধ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন, যা তার ক্যারিয়ারের অন্যতম বড় স্বীকৃতি।
পারিবারিক প্রভাব ও অনুপ্রেরণা
দিতির পারিবারিক জীবনে সাংস্কৃতিক চর্চার প্রভাব ছিল গভীর। পরিবারের সদস্যরা সবসময় তার শিল্পচর্চায় উৎসাহ দিয়েছেন। বিশেষ করে তার মা ছিলেন সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণার উৎস। এই পারিবারিক সমর্থন তাকে সাহস জুগিয়েছে এবং নানা চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও অভিনয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সহায়তা করেছে।
ব্যক্তিগত জীবন ও বিবাহ
দিতি প্রথমে অভিনেতা সোহেল চৌধুরীকে বিয়ে করেন। তাদের সংসারে এক কন্যা ও এক পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। তবে দাম্পত্য জীবনে মতপার্থক্যের কারণে বিচ্ছেদ ঘটে। ব্যক্তিগত জীবনে নানা উত্থান-পতন সত্ত্বেও তিনি সন্তানদের লালন-পালনে ছিলেন নিবেদিত এবং অভিনয় ক্যারিয়ারও চালিয়ে যান।
বিতর্ক ও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু
দিতি বড় কোনো কেলেঙ্কারিতে জড়াননি, তবে ব্যক্তিগত জীবন, স্পষ্টভাষী মনোভাব ও সাহসী মন্তব্যের কারণে মাঝে মাঝে বিনোদন সংবাদে আলোচনায় আসতেন। খোলামেলা মনোভাব ও আত্মবিশ্বাসী উপস্থিতি তাকে আলাদা করে তুলেছিল।
চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার ও বৈচিত্র্য
দিতির চলচ্চিত্রজীবন ছিল বহুমুখী ও সমৃদ্ধ। তিনি রোমান্টিক, পারিবারিক, সামাজিক ও অ্যাকশনধর্মী ছবিতে সমান দক্ষতা দেখিয়েছেন। নব্বইয়ের দশক ও ২০০০ সালের শুরুর দিকে তিনি ছিলেন বাণিজ্যিক ও গুণগত মানসম্পন্ন চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান মুখ। তার প্রতিটি চরিত্র ছিল আলাদা ও দর্শকনন্দিত, যা তাকে প্রায় দুই শতাধিক চলচ্চিত্রে অমর করে রেখেছে।
বিজ্ঞাপন, টেলিভিশন ও মঞ্চ
দিতি টেলিভিশন নাটক, টেলিফিল্ম ও বিজ্ঞাপনেও সফলতা পান। তার ক্যামেরাবান্ধব উপস্থিতি ও স্বাভাবিক অভিনয় টিভি দর্শকের মন জয় করে। তিনি একাধিক মঞ্চনাটকেও অভিনয় করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে প্রবাসী দর্শকদের জন্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন।
সামাজিক কাজ ও মানবসেবা
দিতি ছিলেন সমাজসেবামূলক কাজে সক্রিয়। অসহায় শিল্পী, দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা সহায়তা এবং শিশুদের কল্যাণমূলক কার্যক্রমে তিনি যুক্ত ছিলেন। তহবিল সংগ্রহে অংশগ্রহণ করে তিনি মানবতার প্রতি দায়িত্ব পালন করতেন।
পুরস্কার ও স্বীকৃতি
দিতি তার ক্যারিয়ারে বহু পুরস্কার পেয়েছেন—
- জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী,১৯৮৭, স্বামী স্ত্রীর যুদ্ধ)
- বাচসাস পুরস্কার
- মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার
- টেলিভিশন রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ড
এগুলো তার প্রতিভা ও জনপ্রিয়তার স্বীকৃতি বহন করে।
জীবনের শেষ অধ্যায়
২০১৫ সালে দিতির ব্রেইন টিউমার ধরা পড়ে। দীর্ঘ চিকিৎসার পরও অবস্থার উন্নতি হয়নি। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার অকাল মৃত্যুতে সারা দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোক নেমে আসে।
উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র ও নাটকসমূহ
দিতির উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে— ডাক দিয়ে যায়, আমলা, আত্মত্যাগ, চুমনামা, স্বামী স্ত্রীর যুদ্ধ, হঠাৎ দেখা, বিরহ বিচ্ছেদ, তোমার আমার সংসার, স্বপ্নের নায়ক, প্রিয়জন, শত্রু ধ্বংস, ভালোবাসার প্রতিশোধ, হৃদয়ের আহ্বান, ত্যাগ, প্রেমের শপথ, অন্তরের কথা, অপরাধী, শক্তি, রক্তের প্রতিশোধ, অগ্নিশপথ, আমার চাওয়া, বুকে আছে প্রেম, ভালোবাসা কখনো মরে না, মনের মাঝে তুমি, তুমি শুধু আমার, পথে হলো দেখা, মধুমালা, অন্তরের গভীরে, চিরন্তন প্রেম, ভালোবাসা অশ্রুহীন, বিবাগী মন, নির্ভীক, সন্ধ্যার আলো, জীবন সঙ্গী, তোমার জন্য হৃদয় কাঁদে, শেষ প্রতিশোধ, প্রেম ও প্রতারণা, দূরের মানুষ প্রভৃতি।
টেলিভিশন ও টেলিফিল্মে তিনি অভিনয় করেছেন— প্রিয়জন, এক জীবন, পথের সাথী, সময়ের গল্প, অন্তহীন পথ, অচেনা আলোসহ অসংখ্য জনপ্রিয় নাটকে।
উত্তরাধিকার
দিতি ছিলেন সাহসী, প্রতিভাবান ও মানবিক এক শিল্পী। তার শিল্পীজীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসে অনুপ্রেরণা হিসেবে থেকে যাবে। নারায়ণগঞ্জের এক কিশোরী থেকে জাতীয় চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে ওঠা—তার এই যাত্রা প্রমাণ করে, প্রতিভা, অধ্যবসায় ও পারিবারিক সমর্থন মিললে স্বপ্ন সত্যি হয়।