শরণার্থীর ঢল ও নতুন জীবনের সূচনা
প্রায় দশ বছর আগে সংঘাত ও দারিদ্র্যের কারণে এক মিলিয়নেরও বেশি মানুষ ইউরোপে প্রবেশ করে। ইতালি, জার্মানি ও বেলজিয়ামের মতো দেশে তারা আশ্রয়, কাজ ও ভাষা শিখে নতুন জীবন শুরু করে। তবে প্রকৃত অর্থে এখানে মিশে যাওয়া এখনও চ্যালেঞ্জের। অনেকের মন পড়ে থাকে নিজের জন্মভূমিতে, যেখানে ফিরে যাওয়া হয়তো আর সম্ভব নয়। পুরনো স্মৃতি, শৈশবের দৃশ্য ও হারানোর কষ্ট তাদের বয়ে বেড়াতে হয়। একই সঙ্গে তাদের উপস্থিতি ইউরোপের সমাজকাঠামোও বদলে দিয়েছে।
নাজিরু উসমান আবুবাকার: শিক্ষার স্বপ্ন ও বাস্তবতার মুখোমুখি
নাইজেরিয়ার মাইদুগুরি শহরে বোকো হারামের সহিংসতা থেকে ২০১৪ সালে পালিয়ে নাজিরু তার স্কুল সনদপত্র বুকে নিয়ে ইতালিতে পৌঁছান ২০১৬ সালে। অভিবাসী নৌকায় ভ্রমণের সময় সনদপত্র ভিজে গেলেও সেটিই পরে তুরিন বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি পাওয়ার প্রমাণ হয়। প্রথমে ভাষা না জানায় শিক্ষা প্রায় অসম্ভব মনে হয়েছিল। প্লাম্বার ও রেস্টুরেন্ট কর্মী হিসেবে কাজ করেও একাকিত্ব ও অর্থকষ্টে ভুগেছিলেন। পরে অনলাইনে বিজ্ঞাপন দেখে আইন পড়ার বৃত্তি পান এবং ২০২৪ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেন। বর্তমানে তিনি একটি অভিবাসী সহায়তা কেন্দ্রে কাজ করছেন এবং ২০২৬ সালে ইতালির নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে চান। যদিও তিনি ইতালিকে সুযোগদাতা হিসেবে দেখেন, তবুও অন্যদের জন্য এটি কঠিন জায়গা হতে পারে বলে মনে করেন।

এহাব ম্জেয়াল: সিরিয়া থেকে জার্মানিতে আশ্রয়
সিরিয়ার দেইর আল-জোর থেকে স্ত্রীসহ পালিয়ে ২০১৫ সালে জার্মানিতে পৌঁছান এহাব ম্জেয়াল। তুরস্ক ও বলকান হয়ে যাত্রাপথে ক্ষুধা ও হামলার ভয়ে কাটাতে হয়েছে মাসের পর মাস। জার্মানিতে পৌঁছে প্রথমে স্বপ্নপূরণের অনুভূতি পেলেও ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে গিয়ে হতাশায় ভুগেছেন। সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য ধীরে ধীরে মানিয়ে নিয়ে বর্তমানে লুবেকে নার্স হিসেবে কাজ করছেন। তিনি জার্মানিকে কৃতজ্ঞতা জানালেও নাগরিকত্ব না থাকায় সিরিয়ায় ফিরতে পারেন না, আর অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবন কাটাচ্ছেন।
নাদিয়া ফেইজি: দশ বছরের পরও অনিশ্চিত পরিচয়
আফগানিস্তান থেকে ২০০১ সালে পালিয়ে নাদিয়া ফেইজি ২০১৬ সালে মেয়েকে নিয়ে জার্মানিতে আসেন। প্রথমে মিডিয়া ডিজাইন পড়া ও থিয়েটারে কাজ শুরু করলেও আবাসন সমস্যার কারণে মেয়েকে রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে নিতে হয়। তার শরণার্থী মর্যাদা না থাকায় বছরে একবার সাময়িক অনুমতি নবায়ন করতে হয়, যা গত বছর ঝুলে যায়। ফলে তিনি কাজ বা রাষ্ট্রীয় সহায়তা পাচ্ছেন না। বন্ধু, আত্মীয় ও সঙ্গীর বাড়িতে থাকেন, আর নিজের গাড়িতেই ব্যক্তিগত জিনিসপত্র রাখেন। কঠিন পরিস্থিতিতেও তিনি ফটোগ্রাফি করে ও বই লিখে জীবন চালাচ্ছেন এবং নাগরিকত্ব সমস্যার সমাধান চান।

ইউসুফ হাম্মাদ: গাজা থেকে বেলজিয়ামে নতুন জীবন
ইয়েমেনে জন্ম নেয়া ইউসুফ হাম্মাদ ছোটবেলায় গাজায় চলে আসেন। যুদ্ধ ও অনিশ্চয়তায় ক্লান্ত হয়ে ২০১৪ সালের শেষে গাজা ত্যাগ করেন। তুরস্ক হয়ে গ্রীসে প্রবেশের জন্য একাধিকবার চেষ্টা করলেও কোস্টগার্ডের হাতে আটক হন। শেষ পর্যন্ত লেসবস দ্বীপে পৌঁছে সেখান থেকে বেলজিয়ামে যান এবং ১৮ মাস পর আবাসিক অনুমতি পান। ২০১৮ সালে গাজায় পরিচিত প্রেমিকা মিনাসকে ভিসার মাধ্যমে বেলজিয়ামে আনেন এবং বিয়ে করেন। বর্তমানে তিনি টেক্সটাইল কারখানার সুপারভাইজার ও খণ্ডকালীন অনুবাদক হিসেবে কাজ করেন। স্থানীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তৃতীয় হন। তবে তার মন পড়ে আছে গাজায়—যেখানে পরিবার যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞে বিপর্যস্ত।
দুই বিশ্বের মাঝে ঝুলে থাকা জীবন
এই চারটি গল্পে স্পষ্ট—যুদ্ধ, দারিদ্র্য ও রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে বাঁচতে ইউরোপে আসা অভিবাসীরা নতুন জীবনের সুযোগ পেলেও, অতীতের টান ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তাদের মনকে দুই ভাগে ভাগ করে রেখেছে। একদিকে নতুন জীবনে শিকড় গাড়ার সংগ্রাম, অন্যদিকে জন্মভূমির স্মৃতি ও কষ্ট—সব মিলিয়ে তারা বসবাস করছে দুই বিশ্বের মাঝামাঝি।


সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















