মালয়েশিয়ার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সহিংস ঘটনার ভিডিও এখন প্রায় নিয়মিত। যদি তাতে ধর্মীয় বিভাজনের উপাদান যুক্ত হয়, তবে তা দ্রুত ভাইরাল হয়। চলতি বছরের শুরুতে এমনই একটি ঘটনায় দেখা যায়, রমজান মাসে প্রকাশ্যে খাবার খাওয়ার কারণে এক প্রবীণ মালয় ব্যক্তি এক হতভম্ব কিশোরকে বকাঝকা করে চড় মারছেন।
এ ঘটনা অনেকের কাছে মালয়েশিয়ায় ইসলামের আরও কঠোর হয়ে ওঠার ইঙ্গিত। গত কয়েক দশকে দেশটির মুসলিমরা ক্রমশ রক্ষণশীল হয়ে উঠেছে, যা অনেক সময় মধ্যপ্রাচ্যের কঠোর ধর্মীয় ব্যাখ্যার প্রভাব বহন করে। ২০২৩ সালের পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপ অনুযায়ী, ৮৬ শতাংশ মালয়েশিয়ান মুসলিম শরিয়াকে রাষ্ট্রীয় আইন হিসেবে সমর্থন করে। প্রতিদিন নামাজ পড়েন এমন মুসলিমদের দুই-তৃতীয়াংশের মতে, প্রকৃত মালয়েশিয়ান হতে হলে মুসলিম হওয়া “অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ”। এর ফলে ৩ কোটি জনসংখ্যার এই বহু-জাতিগোষ্ঠীর দেশে জাতিগত সম্পর্কের অবনতি ঘটছে, যেখানে ৬১ শতাংশ মুসলিম (প্রধানত মালয়), ২৩ শতাংশ চীনা বংশোদ্ভূত এবং ৭ শতাংশ ভারতীয় বংশোদ্ভূত।

রাজনীতিতে ধর্মীয় প্রভাব
পর্যবেক্ষকদের মতে, এই ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় রক্ষণশীলতা মালয়েশিয়ার রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলছে। কট্টর ইসলামপন্থী দল পাস (PAS) ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। ২০২২ সালের জাতীয় নির্বাচনে তারা সংসদে সর্বাধিক আসন পায়, যদিও ভোটের হার ছিল মাত্র ১৫ শতাংশ। বর্তমানে তারা বিরোধী জোট পেরিকাতান ন্যাশনাল (PN)-এর সবচেয়ে বড় অংশ। বহু বছর ধরে কেলান্তান ও তেরেঙ্গানু প্রদেশে ক্ষমতায় থাকা পাস ২০২৩ সালে কেদাহ প্রদেশও জয় করেছে। শহরাঞ্চলেও তাদের সমর্থন বাড়ছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, ২০২৮ সালের নির্বাচনে সরকার গঠনের সম্ভাবনাও রয়েছে পাসের, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের ইসলামপন্থী দলগুলোর তুলনায় বিরল সাফল্য।
সমর্থন বৃদ্ধির কারণ
পাসের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির একটি বড় কারণ প্রতিবাদী ভোট। অর্থনৈতিক সংকটে মালয়েশিয়ানদের মধ্যে হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে ক্ষমতায় থাকা ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (UMNO) ২০১৮ সালে দুর্নীতি কেলেঙ্কারিতে ক্ষমতাচ্যুত হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের পাকাতান হারাপান (PH) জোটও বহু প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে বিকল্পহীন ও হতাশ তরুণ মালয়েরা পাসের দিকে ঝুঁকছে। অনুমান অনুযায়ী, ২০২২ সালের নির্বাচনে ৩০ বছরের নিচের প্রায় ৩৭ শতাংশ মালয় ভোটার পাসের জোটকে সমর্থন করেছে, যা আনোয়ারের তুলনামূলক উদারনৈতিক জোটের চেয়ে বেশি। সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যাচ্ছে, তরুণ মালয় ভোটারদের কাছে “ইসলাম রক্ষা” এখন ভোট দেওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড।

দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব
পাসের উত্থান কেবল অর্থনৈতিক অসন্তোষের ফল নয়। ১৯৮০-এর দশকে ইসলামপন্থীদের ভোট প্রতিযোগিতা ঠেকাতে উম্নো সরকার ইসলামায়ন নীতি গ্রহণ করে। এর প্রভাব পড়ে শিক্ষা ব্যবস্থায়ও। সরকারি স্কুলে মালয় শিক্ষার্থীরা প্রতি সপ্তাহে ঘণ্টাব্যাপী ধর্মীয় শিক্ষা পায়। মালয়েশিয়ার ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটির স্যাজা শুকরি বলেন, “যখন ধর্মীয় পরিচয়কে এত গুরুত্ব দেওয়া হয়, তখন শিক্ষার্থীরা বিশ্বাস করে ধর্ম ও রাজনীতি আলাদা করা সম্ভব নয়।”
জাতিগত পরিচয় ও রাজনীতি
মালয় ও ইসলামী পরিচয়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পাসকে রাজনৈতিক সুবিধা দিয়েছে, যা ইন্দোনেশিয়ার ইসলামপন্থীদের তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর। ইন্দোনেশিয়ায় ইসলাম বহু জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে থাকলেও মালয়েশিয়ায় এটি মালয় পরিচয়ের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। তবে সারাওয়াক ও সাবাহ প্রদেশে পাসের প্রভাব সীমিত, কারণ সেখানে মুসলিমরা জাতিগতভাবে বেশি বৈচিত্র্যময়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকা
টিকটক ও ইউটিউবে দক্ষ ইমামরা সম্পর্ক, ব্যক্তিগত অর্থনীতি ইত্যাদি নিয়ে সহজ ভাষায় আলোচনা করে লাখো ভিউ পাচ্ছেন। একই সঙ্গে পাস বিপুল পরিমাণ রাজনৈতিক ভিডিও তৈরি করে টিকটকে ছড়িয়ে দিচ্ছে, যেখান থেকে তরুণ মালয়েরা খবর সংগ্রহ করছে। পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা, অনলাইন ‘ইকো চেম্বার’ দেশটির ধর্মীয় বিভাজনকে আরও গভীর করবে। চড় মারার ভিডিওটির নিচে এক ব্যবহারকারী মন্তব্য করেছেন, “এটা কেবল আরও খারাপ হতে থাকবে।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















