১০:১২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫

কর্মী থাকাকালে সফল উপদেষ্টা হয়ে কেন ব্যর্থ?

বাংলাদেশের পরিবেশ আন্দোলনের শীর্ষ কণ্ঠস্বর সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান কর্মী হিসেবে সিলেট অঞ্চলের অবৈধ পাথর উত্তোলন বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও কাঙ্ক্ষিত ফল আনতে না পারায় বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এটি কি ব্যক্তিগত ব্যর্থতা, নাকি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দুর্বলতা ও রাজনৈতিক চাপের ফল—এ প্রশ্ন সামনে এসেছে।

কর্মী থেকে উপদেষ্টা

আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কৃত এই পরিবেশ আইনজীবী কর্মী অবস্থায় আদালত, গণমাধ্যম ও মাঠপর্যায়ের সরাসরি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে দ্রুত পদক্ষেপ নিতেন। উপদেষ্টা হিসেবে তাঁর ক্ষমতা নীতি প্রস্তাব ও নির্দেশনা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ, যেখানে বাস্তবায়ন নির্ভর করছে প্রশাসনিক সংস্থার ওপর।

সিলেট পাথর বেল্টের পরিবেশগত সংকট

জাফলং, ভোলাগঞ্জ ও বিছানাকান্দিতে অতিরিক্ত ও অবৈধ পাথর উত্তোলনের ফলে নদীর তলদেশ ক্ষয়, তীরভাঙন, জীববৈচিত্র্যের বিলোপ ও পর্যটনের অবনতি ঘটছে। কর্মী অবস্থায় তিনি বহু খনি বন্ধ করলেও বর্তমানে প্রশাসনিক জটিলতা ও রাজনৈতিক প্রভাব এই কাজে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পরিবেশবান্ধব পর্যটন উন্নয়নে সিলেটে মহাপরিকল্পনা : সৈয়দা রিজওয়ানা | |  বাংলাদেশ প্রতিদিন

জাফলং সফর ও ঘোষণাপত্র

চৌদ্দ জুন ২০২৫-এ জাফলং সফরে গিয়ে তিনি ঘোষণা দেন—নতুন লাইসেন্স বন্ধ, অবৈধ ক্রাশিং ইউনিটের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন এবং পরিবেশবান্ধব পর্যটনের জন্য মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হবে। কিন্তু স্থানীয় বিক্ষোভে তাঁর গাড়ি আটকে দেওয়া হয়, যা বাস্তবায়নে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধের প্রমাণ।

অর্থনৈতিক ক্ষতি ও পরিসংখ্যান

গত সাত মাসে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার সমমূল্যের পাথর অবৈধভাবে উত্তোলন হয়েছে। ২০১৭ থেকে ২০২০ সালে অবৈধ খনিতে ৭৬ জন শ্রমিক নিহত ও ২১ জন আহত হয়েছেন। রাজস্ব আদায় মারাত্মকভাবে কমেছে, ফলে বহু শ্রমিক ও ব্যবসায়ী বেকার হয়েছেন।

এলাকাভিত্তিক পরিস্থিতি

জাফলং: প্রায় দশ মিলিয়ন ঘনফুট পাথর উত্তোলনে এক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি; নদীর গভীরতা কমে পানি সংকট ও বন্যার ঝুঁকি বেড়েছে।

ভোলাগঞ্জ: খনি বন্ধ ও খোলার পুনরাবৃত্ত চক্রে প্রায় ৩-৪ লাখ মানুষের জীবিকা অনিশ্চিত।

বিছানাকান্দি: পাথর উত্তোলনে পানির স্বচ্ছতা নষ্ট হয়ে পর্যটক কমে যাচ্ছে, হোটেল–রেস্তোরাঁর আয় হ্রাস পাচ্ছে।

জাফলংয়ে কোটি ঘনফুট পাথর লুট : প্রভাবশালী চক্রের পকেটে ১০০ কোটি টাকা –  Crime Sylhet

সমাধানের রূপরেখা

তাত্ক্ষণিক করণীয় (০–৬ মাস)

বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন, অবৈধ খনি বন্ধ, ক্রাশিং ইউনিট সিলগালা, নদীতে ড্রোন ও জিপিএস নজরদারি, অনলাইন ড্যাশবোর্ডে তথ্য প্রকাশ, শ্রমিকদের জন্য নিরাপত্তা নীতি প্রণয়ন।

মধ্যমেয়াদি করণীয় (৬–১৮ মাস)

এলাকা–ভিত্তিক মাস্টারপ্ল্যান, সংবেদনশীল এলাকায় নিষেধাজ্ঞা, বিকল্প জীবিকার প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্রঋণ, আইন সংস্কার ও কঠোর জরিমানা।

অবশেষে ৬ বছর পর খুলছে পাথর কোয়ারি – Crime Sylhet

দীর্ঘমেয়াদি করণীয় (১৮ মাসের পর)

প্রকৃতি–ভিত্তিক পর্যটন বিনিয়োগ, নদীতীর পুনর্বাসন, ড্রেজিং ও সেডিমেন্ট ব্যবস্থাপনা, ডিজিটাল লাইসেন্স ও অভিযোগ অ্যাপ চালু।

নীতিগত ভারসাম্য

পরিবেশ, জীবিকা ও রাজস্ব—তিনটির মধ্যে সমন্বয় না হলে টেকসই সমাধান সম্ভব নয়। সংবেদনশীল এলাকায় শূন্য সহনশীলতা নীতি, আর নিয়ন্ত্রিত উত্তোলন সম্ভব হলে সীমিত অনুমতি ও বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা জরুরি।

কর্মী সৈয়দা রিজওয়ানার দৃঢ়তা এখন কাঠামোগত সীমাবদ্ধতায় আটকে আছে। ঘোষণাগুলো সঠিক দিকনির্দেশনা দিলেও বাস্তবায়নে প্রয়োজন সমন্বিত ক্ষমতা, কঠোর আইন প্রয়োগ ও স্থানীয় জনগণকে সঙ্গে নেওয়া। একীভূত টাস্কফোর্স, মাস্টারপ্ল্যান, বিকল্প জীবিকা ও প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি কার্যকর হলে সিলেটের পাথর বেল্ট পুনরায় টেকসই সৌন্দর্যে ফিরতে পারে; নচেৎ স্থানীয় সংকট জাতীয় অস্থিতিশীলতায় পরিণত হবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

কর্মী থাকাকালে সফল উপদেষ্টা হয়ে কেন ব্যর্থ?

০৭:৩০:৫৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৩ অগাস্ট ২০২৫

বাংলাদেশের পরিবেশ আন্দোলনের শীর্ষ কণ্ঠস্বর সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান কর্মী হিসেবে সিলেট অঞ্চলের অবৈধ পাথর উত্তোলন বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও কাঙ্ক্ষিত ফল আনতে না পারায় বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এটি কি ব্যক্তিগত ব্যর্থতা, নাকি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দুর্বলতা ও রাজনৈতিক চাপের ফল—এ প্রশ্ন সামনে এসেছে।

কর্মী থেকে উপদেষ্টা

আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কৃত এই পরিবেশ আইনজীবী কর্মী অবস্থায় আদালত, গণমাধ্যম ও মাঠপর্যায়ের সরাসরি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে দ্রুত পদক্ষেপ নিতেন। উপদেষ্টা হিসেবে তাঁর ক্ষমতা নীতি প্রস্তাব ও নির্দেশনা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ, যেখানে বাস্তবায়ন নির্ভর করছে প্রশাসনিক সংস্থার ওপর।

সিলেট পাথর বেল্টের পরিবেশগত সংকট

জাফলং, ভোলাগঞ্জ ও বিছানাকান্দিতে অতিরিক্ত ও অবৈধ পাথর উত্তোলনের ফলে নদীর তলদেশ ক্ষয়, তীরভাঙন, জীববৈচিত্র্যের বিলোপ ও পর্যটনের অবনতি ঘটছে। কর্মী অবস্থায় তিনি বহু খনি বন্ধ করলেও বর্তমানে প্রশাসনিক জটিলতা ও রাজনৈতিক প্রভাব এই কাজে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পরিবেশবান্ধব পর্যটন উন্নয়নে সিলেটে মহাপরিকল্পনা : সৈয়দা রিজওয়ানা | |  বাংলাদেশ প্রতিদিন

জাফলং সফর ও ঘোষণাপত্র

চৌদ্দ জুন ২০২৫-এ জাফলং সফরে গিয়ে তিনি ঘোষণা দেন—নতুন লাইসেন্স বন্ধ, অবৈধ ক্রাশিং ইউনিটের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন এবং পরিবেশবান্ধব পর্যটনের জন্য মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হবে। কিন্তু স্থানীয় বিক্ষোভে তাঁর গাড়ি আটকে দেওয়া হয়, যা বাস্তবায়নে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধের প্রমাণ।

অর্থনৈতিক ক্ষতি ও পরিসংখ্যান

গত সাত মাসে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার সমমূল্যের পাথর অবৈধভাবে উত্তোলন হয়েছে। ২০১৭ থেকে ২০২০ সালে অবৈধ খনিতে ৭৬ জন শ্রমিক নিহত ও ২১ জন আহত হয়েছেন। রাজস্ব আদায় মারাত্মকভাবে কমেছে, ফলে বহু শ্রমিক ও ব্যবসায়ী বেকার হয়েছেন।

এলাকাভিত্তিক পরিস্থিতি

জাফলং: প্রায় দশ মিলিয়ন ঘনফুট পাথর উত্তোলনে এক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি; নদীর গভীরতা কমে পানি সংকট ও বন্যার ঝুঁকি বেড়েছে।

ভোলাগঞ্জ: খনি বন্ধ ও খোলার পুনরাবৃত্ত চক্রে প্রায় ৩-৪ লাখ মানুষের জীবিকা অনিশ্চিত।

বিছানাকান্দি: পাথর উত্তোলনে পানির স্বচ্ছতা নষ্ট হয়ে পর্যটক কমে যাচ্ছে, হোটেল–রেস্তোরাঁর আয় হ্রাস পাচ্ছে।

জাফলংয়ে কোটি ঘনফুট পাথর লুট : প্রভাবশালী চক্রের পকেটে ১০০ কোটি টাকা –  Crime Sylhet

সমাধানের রূপরেখা

তাত্ক্ষণিক করণীয় (০–৬ মাস)

বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন, অবৈধ খনি বন্ধ, ক্রাশিং ইউনিট সিলগালা, নদীতে ড্রোন ও জিপিএস নজরদারি, অনলাইন ড্যাশবোর্ডে তথ্য প্রকাশ, শ্রমিকদের জন্য নিরাপত্তা নীতি প্রণয়ন।

মধ্যমেয়াদি করণীয় (৬–১৮ মাস)

এলাকা–ভিত্তিক মাস্টারপ্ল্যান, সংবেদনশীল এলাকায় নিষেধাজ্ঞা, বিকল্প জীবিকার প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্রঋণ, আইন সংস্কার ও কঠোর জরিমানা।

অবশেষে ৬ বছর পর খুলছে পাথর কোয়ারি – Crime Sylhet

দীর্ঘমেয়াদি করণীয় (১৮ মাসের পর)

প্রকৃতি–ভিত্তিক পর্যটন বিনিয়োগ, নদীতীর পুনর্বাসন, ড্রেজিং ও সেডিমেন্ট ব্যবস্থাপনা, ডিজিটাল লাইসেন্স ও অভিযোগ অ্যাপ চালু।

নীতিগত ভারসাম্য

পরিবেশ, জীবিকা ও রাজস্ব—তিনটির মধ্যে সমন্বয় না হলে টেকসই সমাধান সম্ভব নয়। সংবেদনশীল এলাকায় শূন্য সহনশীলতা নীতি, আর নিয়ন্ত্রিত উত্তোলন সম্ভব হলে সীমিত অনুমতি ও বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা জরুরি।

কর্মী সৈয়দা রিজওয়ানার দৃঢ়তা এখন কাঠামোগত সীমাবদ্ধতায় আটকে আছে। ঘোষণাগুলো সঠিক দিকনির্দেশনা দিলেও বাস্তবায়নে প্রয়োজন সমন্বিত ক্ষমতা, কঠোর আইন প্রয়োগ ও স্থানীয় জনগণকে সঙ্গে নেওয়া। একীভূত টাস্কফোর্স, মাস্টারপ্ল্যান, বিকল্প জীবিকা ও প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি কার্যকর হলে সিলেটের পাথর বেল্ট পুনরায় টেকসই সৌন্দর্যে ফিরতে পারে; নচেৎ স্থানীয় সংকট জাতীয় অস্থিতিশীলতায় পরিণত হবে।