গতকাল পার্দানা পুত্রা কমপ্লেক্সে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী দাতুক সেরি আনোয়ার ইব্রাহিম ও বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুস দুই দেশের গভীর সম্পর্কের পুনর্নিশ্চয়তা দেন। এর আগে জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী, বিদেশি কূটনীতিক এবং রয়্যাল রেঞ্জার রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়নের গার্ড অব অনারসহ আনুষ্ঠানিক স্বাগত অনুষ্ঠিত হয়।
আঞ্চলিক বিষয়ে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, বাংলাদেশ বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে যে “মহান বোঝা” বহন করছে, তা উদ্বেগের বিষয়। তিনি বলেন, “মিয়ানমারে শান্তি প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে মানবিক সহায়তা শরণার্থী ও সংঘাত এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে পৌঁছে যায়। এই ভোগান্তি অনেক বেশি দীর্ঘ হয়েছে।”
তিনি জানান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাতুক সেরি মোহাম্মদ হাসান ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডের সমকক্ষদের সঙ্গে সমন্বয় করে একটি যৌথ আসিয়ান দল গঠন করবেন, যারা আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মিয়ানমার সফর করে জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর নৃশংসতা বন্ধ ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করবে।

তিন দিনের সরকারি সফরে থাকা ড. ইউনুস মালয়েশিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, দেশটি বহু বাংলাদেশির জন্য “দ্বিতীয় বাড়ি”। তিনি বলেন, “আমাদের এত মানুষকে গ্রহণ করার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা আশা করি এই দরজা খোলা থাকবে, বরং আরও প্রশস্ত হবে, যাতে আমাদের আরও তরুণ কাজের সুযোগ পায়, দক্ষতা অর্জন করে দেশে ফিরে নিজস্ব ব্যবসা শুরু করতে পারে।”
দুই নেতা শ্রমসংক্রান্ত বিষয়ও আলোচনা করেন। আনোয়ার জানান, মালয়েশিয়া দেশে আটকে পড়া বাংলাদেশি কর্মীদের সহায়তায় ব্যবস্থা নেবে এবং পরিবারের সঙ্গে দেখা করার সুবিধার্থে একাধিকবার প্রবেশের সুযোগসহ ভিসা প্রদান করবে।
আনোয়ার বলেন, “বাংলাদেশ শুধু শ্রমের উৎস নয়, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অংশীদার।” তিনি পেট্রোনাসের সঙ্গে জ্বালানি প্রকল্প এবং আজিয়াটা গ্রুপের সঙ্গে টেলিযোগাযোগ খাতে চলমান সহযোগিতার কথা উল্লেখ করেন। “আমরা এখন হালাল শিল্প, এসটিইএম (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত) শিক্ষা, গবেষণা এবং সেমিকন্ডাক্টর উন্নয়নে সহযোগিতা জোরদার করতে চাই।”
গতকাল স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকগুলোর মধ্যে ছিল—সামরিক প্রশিক্ষণ জোরদারের জন্য প্রতিরক্ষা সহযোগিতা; প্রযুক্তি বিনিময়; আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও জ্বালানি অংশীদারত্ব (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ ও অবকাঠামো উন্নয়নসহ); হালাল অর্থনীতি বিষয়ক সহযোগিতা (সার্টিফিকেশন ও বাণিজ্য সম্প্রসারণে গুরুত্বারোপ); শিক্ষা ও শ্রম সহযোগিতা (একাডেমিক বিনিময়, কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং দুই দেশের থিংক ট্যাংকের মধ্যে কৌশলগত গবেষণা অংশীদারত্ব); সেমিকন্ডাক্টর সক্ষমতা বৃদ্ধি উদ্যোগ; এবং বাণিজ্য প্রমোশন জোরদার।

মাইক্রোক্রেডিট ও দারিদ্র্য বিমোচনে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. ইউনুস বাংলাদেশের নির্বাচনকে সামনে রেখে মালয়েশিয়ার সমর্থন চান এবং বিশেষ করে ২০২৫ সালে মালয়েশিয়ার আসিয়ান সভাপতিত্বকালে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বৈশ্বিক পর্যায়ে জোরালো সোচ্চারতা নিশ্চিত করতে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের মানবসম্পদ ও প্রযুক্তি আছে। আমরা টেকসই, উচ্চ প্রবৃদ্ধির অর্থনীতি গড়তে মালয়েশিয়ার বিনিয়োগ চাই।” তিনি আরও বলেন, অতীতের নানা জাতীয় চ্যালেঞ্জের সময় আনোয়ার “প্রয়োজনে পাশে থাকা বন্ধু” ছিলেন।
ড. ইউনুস আজ একটি উন্মুক্ত বক্তৃতা দেবেন এবং ইউনিভার্সিটি কেবাংসান মালয়েশিয়া থেকে সোশ্যাল বিজনেসে সম্মানসূচক দর্শন ডক্টরেট ডিগ্রি গ্রহণ করবেন। এরপর তিনি ইউনুস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার ও এর বিশ্ববিদ্যালয় নেটওয়ার্কের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।
২০২৪ সালে মালয়েশিয়া–বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ৫.১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১৩.৩৫ বিলিয়ন মালয়েশিয়ান রিঙ্গিতে। বাংলাদেশের উদ্দেশে মালয়েশিয়ার প্রধান রপ্তানি পণ্য হলো পেট্রোলিয়ামজাত সামগ্রী, পাম তেল ও রাসায়নিক দ্রব্য; আর বাংলাদেশ থেকে আমদানির মধ্যে রয়েছে টেক্সটাইল, জুতা ও বিভিন্ন নির্মিত পণ্য।
১৯৭২ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকে দুই দেশ এমন এক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, যাকে আনোয়ার বর্ণনা করেছেন “সমমর্যাদার অংশীদারত্ব—যার ভিত্তি আস্থা, যৌথ আকাঙ্ক্ষা এবং এই বিশ্বাস যে একসঙ্গে আমরা আমাদের জনগণ ও অঞ্চলটির জন্য আরও অনেক কিছু করতে পারি”।
সারাক্ষণ ডেস্ক 



















