১০:৪২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫

সিলেটের সাদা পাথর কারা চুরি করছে- কেন সরকার ব্যর্থ

সিলেটের জাফলং ও বিছানাকান্দি অঞ্চলের সাদা পাথর শুধু প্রাকৃতিক সম্পদই নয়, দেশের ভূপ্রকৃতি, পর্যটন ও স্থানীয় অর্থনীতির জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিকল্পিতভাবে এই সাদা পাথর পাচারের ঘটনা বেড়েছে। স্থানীয় সূত্র, সাংবাদিক প্রতিবেদন ও পরিবেশবাদী সংগঠনের অভিযোগ অনুযায়ী, চোরাচালানচক্র এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে সরকারি সংস্থাগুলোও অনেক ক্ষেত্রে কার্যকরভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না।

কারা এই পাথর চুরির সঙ্গে জড়িত

স্থানীয়দের দাবি, পাথর চোরাচালানের মূল খেলোয়াড় হলো সীমান্তবর্তী এলাকার একটি সংগঠিত সিন্ডিকেট। এতে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী, পরিবহনমালিক এবং রাজনীতির  ভেতরের কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্যও জড়িত থাকতে পারে। তাদের কার্যপ্রণালী সাধারণত রাতের অন্ধকারে সীমান্ত নদীপথ ব্যবহার করে ভারত থেকে অবৈধভাবে পাথর আনা, অথবা দেশের অভ্যন্তরে নদীর তলদেশ ও অননুমোদিত স্থানে উত্তোলন করে দ্রুত বাজারজাত করা। এ কাজে ভুয়া কাগজপত্র, নম্বরপ্লেট পরিবর্তন, রুট-বদল ও প্রভাব খাটানোর মতো কৌশল ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয় প্রশাসনে রাজনৈতিক প্রভাব থাকায় নানাবিধ ...

সরকারের ব্যর্থতা ও শিথিল তদারকি

স্থানীয় প্রশাসন সাম্প্রতিক সময়ে অনেক ভয়ের মধ্যে আছে। তারা যে কোন কিছুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভয় পাচ্ছে।

তদারকির ঘাটতি: সীমান্ত এলাকা ও নদীপথে পর্যাপ্ত চেকপোস্ট, নৌ-টহল ও প্রযুক্তিভিত্তিক নজরদারি না থাকায় নিয়মিত মনিটরিং ব্যাহত হয়। ধরা পড়লেও প্রভাব খাটিয়ে অনেক আসামি দ্রুত জামিনে মুক্তি পায়; মামলা দীর্ঘসূত্রতায় ঝুলে থাকে, প্রমাণ সংগ্রহ ও চার্জশিট দাখিলে দেরি হয়।

রাজনৈতিক প্রভাব: স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তি ও বর্তমানের ক্ষমতাবান তরুণদের পৃষ্ঠপোষকতায় চোরাচালানকারীরা সুরক্ষা পায়, ফলে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা অনেক সময় সিদ্ধান্তে দ্বিধাগ্রস্ত হন।

পরিবেশ ও অর্থনীতিতে প্রভাব

অবৈধ উত্তোলনে নদীর তলদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বদলে যায় এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি ঘটে। পর্যটনকেন্দ্রগুলোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ায় পর্যটকের আগ্রহ কমে যায়; এতে হোটেল-মোটেল, দোকান, রিকশা ও নৌযানচালকসহ স্থানীয় সেবা-খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একই সঙ্গে সরকার রাজস্ব হারায়, যা বছরে উল্লেখযোগ্য অঙ্কে পৌঁছে।

সিলেটে সাদা পাথর উদ্ধারে অভিযান শুরু | সারাদেশ | বাংলা এডিশন

করণীয় ও প্রস্তাবনা

১) সীমান্ত ও নদীপথে ড্রোন, নৌ-প্যাট্রোল বডি-ওয়ার্ন ক্যামেরা, এএনপিআর (স্বয়ংক্রিয় নম্বরপ্লেট শনাক্তকরণ) ও জিপিএস ট্র্যাকারসহ আধুনিক নজরদারি প্রযুক্তি স্থাপন।
২) অনুমোদিত খনি, ডাম্পিংইয়ার্ড ও পরিবহনে ডিজিটাল ট্র্যাকিং ও ই-ম্যানিফেস্ট বাধ্যতামূলক করা; সব লাইসেন্স ও টোকেনিং অনলাইনে আনা।
৩) চোরাচালানচক্রের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মদদদাতাদের আর্থিক গোয়েন্দা তদন্ত (এএমএল/সিএফটি) ও সম্পদ জব্দের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন করা।
৪) বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা; তদন্তের মানোন্নয়নে ফরেনসিক প্রমাণ, জিওস্পেশাল ডেটা ও সিসিটিভি ফুটেজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো।
৫) স্থানীয় জনগণ ও পর্যটনখাতের অংশীজনদের নিয়ে কমিউনিটি-ভিত্তিক নজরদারি কাঠামো গঠন; সচেতনতা ও বিকল্প জীবিকার সুযোগ বাড়ানো, যাতে অবৈধ উত্তোলনের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা কমে।

এছাড়া বর্তমানের ক্ষমতাবান তরুণদের বিরুদ্ধে সরকারের দৃঢ় অবস্থান প্রয়োজন।

দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা, কঠোর আইনি প্রয়োগ ও স্বচ্ছ তদারকি ছাড়া সিলেটের সাদা পাথর সংরক্ষণ সম্ভব নয়। এখনই সমন্বিত উদ্যোগ না নিলে প্রাকৃতিক ঐতিহ্য ধ্বংসের ঝুঁকি বাড়বে এবং চোরাচালানচক্র আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

সিলেটের সাদা পাথর কারা চুরি করছে- কেন সরকার ব্যর্থ

০৪:৫৪:৩২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ অগাস্ট ২০২৫

সিলেটের জাফলং ও বিছানাকান্দি অঞ্চলের সাদা পাথর শুধু প্রাকৃতিক সম্পদই নয়, দেশের ভূপ্রকৃতি, পর্যটন ও স্থানীয় অর্থনীতির জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিকল্পিতভাবে এই সাদা পাথর পাচারের ঘটনা বেড়েছে। স্থানীয় সূত্র, সাংবাদিক প্রতিবেদন ও পরিবেশবাদী সংগঠনের অভিযোগ অনুযায়ী, চোরাচালানচক্র এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে সরকারি সংস্থাগুলোও অনেক ক্ষেত্রে কার্যকরভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না।

কারা এই পাথর চুরির সঙ্গে জড়িত

স্থানীয়দের দাবি, পাথর চোরাচালানের মূল খেলোয়াড় হলো সীমান্তবর্তী এলাকার একটি সংগঠিত সিন্ডিকেট। এতে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী, পরিবহনমালিক এবং রাজনীতির  ভেতরের কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্যও জড়িত থাকতে পারে। তাদের কার্যপ্রণালী সাধারণত রাতের অন্ধকারে সীমান্ত নদীপথ ব্যবহার করে ভারত থেকে অবৈধভাবে পাথর আনা, অথবা দেশের অভ্যন্তরে নদীর তলদেশ ও অননুমোদিত স্থানে উত্তোলন করে দ্রুত বাজারজাত করা। এ কাজে ভুয়া কাগজপত্র, নম্বরপ্লেট পরিবর্তন, রুট-বদল ও প্রভাব খাটানোর মতো কৌশল ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয় প্রশাসনে রাজনৈতিক প্রভাব থাকায় নানাবিধ ...

সরকারের ব্যর্থতা ও শিথিল তদারকি

স্থানীয় প্রশাসন সাম্প্রতিক সময়ে অনেক ভয়ের মধ্যে আছে। তারা যে কোন কিছুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভয় পাচ্ছে।

তদারকির ঘাটতি: সীমান্ত এলাকা ও নদীপথে পর্যাপ্ত চেকপোস্ট, নৌ-টহল ও প্রযুক্তিভিত্তিক নজরদারি না থাকায় নিয়মিত মনিটরিং ব্যাহত হয়। ধরা পড়লেও প্রভাব খাটিয়ে অনেক আসামি দ্রুত জামিনে মুক্তি পায়; মামলা দীর্ঘসূত্রতায় ঝুলে থাকে, প্রমাণ সংগ্রহ ও চার্জশিট দাখিলে দেরি হয়।

রাজনৈতিক প্রভাব: স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তি ও বর্তমানের ক্ষমতাবান তরুণদের পৃষ্ঠপোষকতায় চোরাচালানকারীরা সুরক্ষা পায়, ফলে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা অনেক সময় সিদ্ধান্তে দ্বিধাগ্রস্ত হন।

পরিবেশ ও অর্থনীতিতে প্রভাব

অবৈধ উত্তোলনে নদীর তলদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বদলে যায় এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি ঘটে। পর্যটনকেন্দ্রগুলোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ায় পর্যটকের আগ্রহ কমে যায়; এতে হোটেল-মোটেল, দোকান, রিকশা ও নৌযানচালকসহ স্থানীয় সেবা-খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একই সঙ্গে সরকার রাজস্ব হারায়, যা বছরে উল্লেখযোগ্য অঙ্কে পৌঁছে।

সিলেটে সাদা পাথর উদ্ধারে অভিযান শুরু | সারাদেশ | বাংলা এডিশন

করণীয় ও প্রস্তাবনা

১) সীমান্ত ও নদীপথে ড্রোন, নৌ-প্যাট্রোল বডি-ওয়ার্ন ক্যামেরা, এএনপিআর (স্বয়ংক্রিয় নম্বরপ্লেট শনাক্তকরণ) ও জিপিএস ট্র্যাকারসহ আধুনিক নজরদারি প্রযুক্তি স্থাপন।
২) অনুমোদিত খনি, ডাম্পিংইয়ার্ড ও পরিবহনে ডিজিটাল ট্র্যাকিং ও ই-ম্যানিফেস্ট বাধ্যতামূলক করা; সব লাইসেন্স ও টোকেনিং অনলাইনে আনা।
৩) চোরাচালানচক্রের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মদদদাতাদের আর্থিক গোয়েন্দা তদন্ত (এএমএল/সিএফটি) ও সম্পদ জব্দের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন করা।
৪) বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা; তদন্তের মানোন্নয়নে ফরেনসিক প্রমাণ, জিওস্পেশাল ডেটা ও সিসিটিভি ফুটেজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো।
৫) স্থানীয় জনগণ ও পর্যটনখাতের অংশীজনদের নিয়ে কমিউনিটি-ভিত্তিক নজরদারি কাঠামো গঠন; সচেতনতা ও বিকল্প জীবিকার সুযোগ বাড়ানো, যাতে অবৈধ উত্তোলনের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা কমে।

এছাড়া বর্তমানের ক্ষমতাবান তরুণদের বিরুদ্ধে সরকারের দৃঢ় অবস্থান প্রয়োজন।

দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা, কঠোর আইনি প্রয়োগ ও স্বচ্ছ তদারকি ছাড়া সিলেটের সাদা পাথর সংরক্ষণ সম্ভব নয়। এখনই সমন্বিত উদ্যোগ না নিলে প্রাকৃতিক ঐতিহ্য ধ্বংসের ঝুঁকি বাড়বে এবং চোরাচালানচক্র আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে।